We make 🌍 Biggest bengali library @ 🚅 speed please wait some⏳️
Posts

২৪) কালিন্দী – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

২৪
মজুমদার এই দৌত্য লইয়া ইন্দ্র রায়ের সম্মুখে উপস্থিত হইবার কল্পনায় চঞ্চল হইয়া পড়িল। ইন্দ্র রায়ের দাম্ভিকতা-ভরা দৃষ্টি, হাসি, কথা সুতীক্ষ্ণ সায়কের মত আসিয়া তাহার মর্মস্থল যেন বিদ্ধ করে। আর তাহার নিজের বাক্যবাণগুলি যতই শান দিয়া শানিত করিয়া সে নিক্ষেপ করুক, নিক্ষেপ ও শক্তির অভাবে সেগুলি কাঁপিতে কাঁপিতে নতশির হইয়া রায়ের সম্মুখে যেন প্রণত হইয়া লুটাইয়া পড়ে। তবে এবার পৃষ্ঠদেশে আছেন সক্ষম রথী বিমলবাবু; বিমলবাবুর আজিকার এই বাক্য-শাকটি শুধু সুতীক্ষ্ণই নয়, শক্তির বেগে তাহার গতি অকম্পিত এবং সোজা। মজুমদার একটা সভয় হিংস্রতায় চঞ্চল হইয়া উঠিল।

নানা কল্পনা করিতে করিতেই সে চর হইতে নদীর ঘাটে আসিয়া নামিল। চরের উপর নদীর মুখ পর্যন্ত রাস্তাটা এখন পাকা হইয়া গিয়াছে, কালীর বুকেও এখন গাড়ির চাকায় চাকায় বেশ একটি চিহ্নিত রাস্তা রায়হাটের খেয়াঘাটে গিয়া উঠিয়াছে। ও-পার হইতে মজুরশ্রেণীর পুরুষ ও মেয়েরা দল বাঁধিয়া চরের দিকে আসিতেছে। কলের ইমারতের কাজে ইহারা এখন খাটে, আগের চেয়ে মজুরিও কিছু বাড়িয়াছে। কতকগুলি চাষী বেগুন-মুলা-শাকশব্জি বোঝাই ঝুড়ি মাথায় চরের দিকেই আসিতেছে। এখন রায়হাটের চেয়ে জিনিসপত্র চরেই কাট্‌তি হয় বেশী, চরে মিস্ত্রি-মজুরেরা দরদস্তুর করে কম, কেনেও পরিমানে বেশী। এ-পারে যাহারাই আসিতেছিল, তাহারা সকলেই মজুমদারকে সশদ্ধ অভিবাদন জানাইল, মজুমদার এখন কলের ম্যানেজার। রায়হাটের ঘাটে আসিয়া মজুমদার বিরক্ত হইয়া উঠিল, পথে এক হাঁটু ধূলা হইয়াছে। চারিপাশে দীর্ঘকালের প্রাচীন গাছের ঘন ছায়ার মধ্যে হিম যেন জমাট বাঁধিয়া আছে। পথের উপর মানুষ-জনও নাই। মজুমদার চরের ম্যানেজারির গৌরবের গোপন অহঙ্কার নির্জনতার সুযোগে প্রকাশ করিয়া ফেলিল বেশ জোর গলাতেই, আপন মনেই সে বলিয়া উঠিল, মা-লক্ষ্মী যখন ছাড়েন, তখন এই দশাই হয়। হুঁ, অতিদর্পে হতা লঙ্কা অতিমানে চ কৌরবাঃ।

পথের দুই পাশে প্রাচীন কালের নৌকার মত বাঁকানো চালকাঠামোযুক্ত কোঠাঘরগুলির দিকে চাহিয়া তাহার ঘৃণা হইল। বলিল, হুঁ, কি সব জঘন্য চাল-কাঠামো! সেকালের কি সবই ছিল কিম্ভুত-কিমাকার! যত জবড়জং-হাতীর শুঁড়, পরী, সিংহী-এই দিয়ে আবার বাহার করেছে। ঘর করবে বাংলো-চাল, সোজা একেবারে পাকা দালান ঘরের মত।

মোট কথা রায়হাটের সমস্ত কিছুকে ঘৃণা করিয়া, ব্যঙ্গ করিয়া ইন্দ্র রায়ের সম্মুখীন হইবার মত মনোবৃত্তিকে সে নিজের অজ্ঞাতেই দৃঢ় করিয়া লইতেছিল।

নায়েব সেরেস্তার সম্মুখে একখানা সেকেলে ভারী কাঠের চেয়ারে বসিয়া ইন্দ্র রায় জমিদারী কাজকর্মের তদারক করিতেছিলেন। নায়েব মিত্তির তক্তাপোশে বসিয়া একটি সেকেলে ডেস্কের উপর খাতা লইয়া বসিয়া আছে। এই লোকটিকে রায় চক্রবর্তী-বাড়ির কর্মচারি নিযুক্ত করিয়াছেন। মনে গোপন ইচ্ছা, এইবার তিনি ধীরে ধীরে চক্রবর্তীদের সংস্রব হইতে সরিয়া দাঁড়াইবেন।

মজুমদার ঘরে ঢুকিয়া নমস্কারের ভঙ্গিতে প্রণাম করিয়া বলিল, একবার মুখুজ্জে সায়েব আপনার কাছে পাঠালেন।

বিমলবাবু এখানে মুখার্জি সাহেব নামেই খ্যাত হইয়াছেন। বাবু নামটি তিনি অপছন্দ করেন, বলেন, ওটা গালাগালি। চরে কুলী কামিন ও রায়হাটের দরিদ্র জনসাধারণের কাছে তিনি মালিক, হুজুর। কর্মচারী ও অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত সাধারণের নিকট তিনি মুখার্জি সাহেব।

ইন্দ্র রায়ের পাশে আরও খানতিনেক চেয়ার খালি পড়িয়া ছিল। মজুমদার তাহার কথার ভূমিকা শেষ করিয়া ওই চেয়ারগুলার দিকেই দৃষ্টি ফেরাইল ; ইন্দ্র রায় সাদরে সম্ভাষণ জানাইয়া মিত্তিরের তক্তাপোশের দিকে আঙুল দেখাইয়া স্পষ্ট নির্দেশ দিয়া বলিলেন, বস বস।

মজুমদার একটু ইতস্তত করিয়া তক্তাপোশের উপরে বসিল। রায় তাঁহার অভ্যস্ত মৃদু হাসি হাসিয়া বলিলেন, কি সংবাদ তোমার মুখার্জি সাহেবের, বল?

আজ্ঞে। মাথা চুলকাইয়া যোগেশ মজুমদার বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিল, আজ্ঞে আমাকে যেন অপরাধী করবেন না-

ইন্দ্র রায়ের ঠোঁটের প্রান্তে যে হাসির রেখাটুকু ফুটিয়া উঠে, সেটা অভিজাতসুলভ অভ্যাস করা একটা ভঙ্গিমাত্র, হাসি নয়; মজুমদারের বিনয়ের ভূমিকা দেখিয়া কিন্তু রায় এবার সত্য সত্যই একটু হাসিলেন। বুঝিলেন, অস্ত্র প্রয়োগের পূর্বে মজুমদারের এটি প্রণাম-বাণ প্রয়োগ। রায় হাসিয়া সোজা হইয়া বসিলেন, দূত চিরকালই অবধ্য; তোমার ভয় নেই; নির্ভয়ে তুমি মুখার্জি সাহেবের বক্তব্য ব্যক্ত কর।

রায়ের কথার সুরে অর্থে মজুমদার তাঁহার শক্তি অনুমান করিয়া আরও সংহত এবং সংযত হইয়া উঠিল, আরও খানিকটা বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিল, তিনি নিজেই আসতেন। তা তাঁর শরীরটা-। মজুমদার ভাবিতেছিল, কোন অসুখের কথা বলিবে।

শরীরটায় আবার কি হল তার? প্রশ্ন করিয়াই রায় হাসিলেন, বলিলেন, চালুনিতে যে-কালে সরষে রাখা চলছে যোগেশ, সে-কালে শরীরে যা হোক একটা কিছু হওয়ার আর আশ্চর্য কি? তোমার শরীর কেমন?

লজ্জার সহিত মজুমদার বলিল, আজ্ঞে, আমি ভালই আছি।

রায় বাঁ হাতে গোঁফে তা দিতে শুরু করিয়া বলিলেন, ভাল কথা, শরীর তো সুস্থই আছে, এইবার সরল অন্তঃকরণে স্পষ্ট ভাষায় বল তো, মুখার্জি সাহেবের কথাটা কি?

বাঁ হাতে গোঁফে তা দেওয়াটা রায়ের অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যের একটা বহিঃপ্রকাশ।

মজুমদার প্রাণপণে আপনাকে দৃঢ় করিয়া বলিল, বেশ গাম্ভীর্যের সহিতই আরম্ভ করিল, কথাটা চরের সাঁওতালদের নিয়ে। মানে, উনি সাঁওতালদের সব দাদন দিয়ে রেখেছেন। শ্রীবাসের কাছে ধানের বাকী বাবদ কারও বিশ, কারও ত্রিশ, দু’একজনের চল্লিশ টাকাও ধার ছিল। শ্রীবাসের প্যাঁচালো বুদ্ধি তো জানেন, সে আবার ডেমিতে টিপছাপ নিয়ে বন্ধকী দলিল পর্যন্ত করে নিয়েছিল। যোগেশ একটু থামিল।

রায়ের গোঁফে তা দেওয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, তাঁহার মুখ-চোখ ধীরে ধীরে চিন্তাভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

মজুমদার কোন সাড়া না পাইয়া বলিল, মুখার্জি সাহেব সেটা জানতে পেরেই শ্রীবাসকে ডেকে ধমক দিয়ে তার টাকা দিয়ে খতগুলি কিনে নিলেন। সাঁওতালদের বললেন, তোরা খেটে আমাকে শোধ দিবি। মজুরি থেকে দৈনিক এক আনা হিসেবে কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি।

রায় নীরবে চিন্তাভারাতুর দৃষ্টিকে অন্তর্মূখী করিয়া চাহিয়া ছিলেন অদৃষ্টলোকের সন্ধানে, কিছু কি দেখা যায়? দেখা কিছু যায় না, কিন্তু অনুভব করিলেন যে, জীবন-পথ অতি উচ্চ পাহাড়ের উপর দিয়া চলিয়াছে, সঙ্কীর্ণ পথ, পাশ ফিরিয়া গতি পরিবর্তনের উপায় নাই। গতি পরিবর্তন করিতে গেলে, তাঁহারই হাত ধরিয়া যিনি চলিয়াছেন, পঙ্গু, রুগ্‌ণ রামেশ্বর-তাঁহাকেই পাশের খাদে ঠেলিয়া ফেলিতে হইবে। সে ফেলিতে গেলে তাঁহাকেও পড়িতে হইবে এ-পাশের অতল অন্ধকারে-অধোগতির তমোলোকে, কৃতঘ্নতার নরকে।

মজুমদার বলিয়াই গেল, এখন ধরুন, এই সব দাদনের কুলী যদি আপনি আটক করেন, তা হলে কি করে চলে বলুন?

চিন্তাকুলতার মধ্যেও রায় কথাগুলি শুনিতেছিলেন। তিনি এবার সপ্রশ্ন ভঙ্গিতে মিত্তিরের ভাইপোর দিকে চাহিয়া বলিলেন, কি ব্যাপার, রাধারমণ?

রমণ বলিল, আজ্ঞে, আটক কেন করতে যাব! তবে এখন ধান কাটার সময়, মাঝিরা আমাদের খাসের জমির ধান কাটছিল না, তাই তাদের কাটতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর ধরুন, অঘ্রাণের শেষ সপ্তাহ হয়ে গেল, এখনও রবি-ফসল বুনল না ওরা, কেবল কলেই খেটে যাচ্ছে; সেই জন্যেই বলা হয়েছে যে, আগে এসব কর, তারপর তোমরা যা করবে কর গে।

মজুমদার প্রতিবাদ করিয়া একটু চড়া সুরে এবার বলিয়া উঠিল, যারা ভাগীদার নয়, তাঁদেরও আপনারা বেগার ধরেছেন খাসের জমির ধান কাটবার জন্যে।

রায় রমণের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, বেগারও ধরা হয়েছে বুঝি?

রমণ উত্তর দিবার পূর্বেই মজুমদার বলিয়া উঠিল, ধরা হয়েছে এবং আপনার নাম দিয়ে ধরা হয়েছে। আপনার নাম না নিলে সাহেব আমাকে পাঠাতেন না, বেগার উঠিয়ে নিতেন। সাঁওতালপাড়ায় সকলেই বললে, আমাদের রাঙাবাবুর শ্বশুর, রায় হুজুর হুকুম দিলে, বেগার দিতে হবে। কথার সঙ্গে সঙ্গে একটি শ্লেষভরা হাসি তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল।

মুহূর্তে রায়ের মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চোখ বুজিয়া স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন, কিছুক্ষণ পর একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তারা, তারা মা! সে কণ্ঠস্বর ধীর এবং প্রশান্ত; সারা ঘরটা যেন থমথম করিয়া উঠিল। পরমুহূর্তে রায় নড়িয়া-চড়িয়া বসিলেন। সজাগ হইয়া বাঁ-হাতে আবার গোঁফে তা দিতে দিতে হাসিয়া বলিলেন, তারপর?

মজুমদার শঙ্কিত হইয়া বলিল, আজ্ঞে?

হাসিয়াই রায় বলিলেন, এখন মুখার্জি সাহেবের বক্তব্যটা কি?

আজ্ঞে, বেগার নিতে গেলে আমাদের কি করে চলে, বলুন? তা ছাড়া ভেবে দেখুন, বেগার প্রথাটাও হল বে-আইনী।

ওঃ, আইন! আইনের কথাটা আমার স্মরণ ছিল না। তা আইনে কি বলছে শুনি?

মজুমদার কথাটার সম্যক অর্থ বুঝিতে না পারিয়া শঙ্কিতভাবেই বলিল, আজ্ঞে?

তোমার মুখার্জি সাহেবকে বলো, তিনি বুঝবেন, তুমি বুঝবে না। বলো আমাদের জমিদারির সনদ বাদশাহী আমলের, -বেগার ধরার অভ্যেস আমাদের অনেক দিনের। কেউ ছাড়তে বললেই কি ছাড়া যায়? বেগার আমরা চিরকালই ধরে আসছি, ধরবও।

তারপর হা হা করিয়া হাসিয়া বলিলেন, দরকার হলে তোমার মুখার্জি সাহেবকেও বেগার দিতে হবে হে। চক্রবর্তী-বাড়িতে ক্রিয়াকর্ম হলে-ওঁকেও আমরা কোন কাজে লাগিয়ে দেব। কাজ তো নানা ধারার আছে।

মজুমদার সুযোগ পাইয়া চট করিয়া বলিয়া উঠিল, কাজ তো হাতের কাছে, আপনি ইচ্ছা করলেই তো লেগে যায়। উমা-মায়ের সঙ্গে অহীনবাবুর বিয়েটা এইবার লাগিয়ে দিন।

রায় হাসিয়া এবার বলিলেন, ছেলেমেয়ে থাকলেই বিয়ের কল্পনা হয় মজুমদার, পাত্রপক্ষ-পাত্রীপক্ষ তো করেই নানা কল্পনা, আবার পাড়াপড়শীতেও পাঁচরকম ভাবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ভগবানের হাতে, ভগবানের দয়া যদি হয় তবে হবে বৈকি। সে হলে তুমি জানতে পারবে সকলের আগে। যিনিই অহীন্দ্রের শ্বশুর হোন, তাঁকে আশীর্বাদের সময় তোমাকে একটা শিরোপা দিতেই হবে। চক্রবর্তী-বাড়ির প্রাচীন কর্মচারী তুমি, আপনার জন।

শব্দার্থে ‘শিরোপা’ ‘প্রাচীন কর্মচারী’ শব্দগুলি ক্ষুরধার। মজুমদারের মর্মস্থলে বিদ্ধ হইবার কথা। কিন্তু রায়ের কণ্ঠস্বরে সুরের গুণ ছিল আজ অন্যরূপ; আঘাত করিবার জন্য ব্যঙ্গ-শ্লেষের নিষ্ঠুর গুণ টানিতে তাঁহার আর প্রবৃত্তি ছিল না; অদৃষ্টবাদী মনের দৃষ্টি আপনার ইষ্টদেবীর চরণপ্রান্তে নিবদ্ধ রাখিয়া তিনি কথা বলিতেছিলেন। মজুমদার আজ আহত হইল না, বরং সে সুরের কোমল স্পর্শে বিচলিত ও লজ্জিত হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া সে এবার অকৃত্রিম সরলতার সহিতই বলিল, আজ্ঞে বাবু, ওই চরের সাঁওতালদের ব্যাপারটা কি কোন রকমে আপোস করা যায় না?

রায় বলিলেন, কার সঙ্গে আপোস যোগেশ? বিমলবাবুর সঙ্গে? তিনি হাসিলেন।

মজুমদার বলিল, লোকটি বড় ভয়ানক বাবু। ধর্ম-ধর্ম কোন কিছু মানেন না। আর লোকটির কূটবুদ্ধিও অসাধারণ।

রায় আবার হাসিলেন, কোন উত্তর দিলেন না।

মজুমদার বলিল, সর্দার মাঝির নাতনী ওই সারী মাঝিনের ব্যাপারটা আমরা তো ভেবেছিলাম, সাঁওতালরা একটা হাঙ্গামা বাধালো বুঝি। কিন্তু এমন খেলা খেললে মশায় যে, কমল আর সারীর স্বামীই হল দেশত্যাগী, আর সমস্ত সাঁওতাল হল বিমলবাবুর পক্ষে। তারা কথাটি কইলে না। আর কি জঘন্য রুচি লোকটার।

রায় বলিলেন, এতে আর ভয় পাবার কি আছে? ও-খেলা আমাদের পুরনো হয়ে গেছে। আগেকার কালে কর্তারা ও-দিকে ভয়ানক খেলা খেলে গেছেন। এ-খেলা ব্যবসায়ীর পক্ষে নতুন। মা-লক্ষ্মীর কপালই ওই, পেছনে পেছনে অলক্ষ্মী জুটবেই। বাণিজ্য-লক্ষ্মীর ঘরে সতীন ঢুকেছে অলক্ষ্মী। যাক গে, ও কথাটা বাদই দাও।

মজুমদার আবার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল, ঝগড়া-বিবাদটা না হলেই ভাল হত বাবু।

ঝগড়া-বিবাদ? রায় গোঁফে তা দিয়া হাসিয়া বলিলেন, ঝগড়া-বিবাদ করতে তা হলে মুখার্জি সাহেব বদ্ধপরিকর, কি বল?

হ্যাঁ, তা যে রকম মনে হল, তাতে-। মজুমদার ইঙ্গিতে কথাটা শেষ করিয়া নীরব হইয়া গেল।

রায় বলিল, জান তো, আগেকার কালে যুদ্ধের আগে এক রাজা আরেক রাজার কাছে দূত পাঠাতেন; সোনার শেকল আর খোলা তলোয়ার নিয়ে আসত সে দূত। যেটা হোক একটা নিতে হত। তা তোমার মুখার্জি সাহেবকে বলো, খোলা তলোয়ারখানাই নিলাম, শেকল নেওয়া আমাদের কুলধর্মে নিষিদ্ধ, বুঝেছ?

কথা বলিতে বলিতে রায়ের চেহারায় একটা আমূল পরিবর্তন ঘটিয়া গেল; ব্যঙ্গহাস্যে মুখ ভরিয়া উঠিয়াছে, গোঁফের দুই প্রান্ত পাক খাইয়া উঠিয়াছে, চোখের দৃষ্টিই হইয়া উঠিয়াছে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর। উৎফুল্ল উগ্র সে দৃষ্টির সম্মুখে সব কিছু যেন তুচ্ছ। কপালে সারি সারি তিনটি বলিরেখা অবরুদ্ধ ক্রোধের বাঁধের মত জাগিয়া উঠিয়াছে।

মজুমদার আর কোন কথা বলিতে সাহস করিল না, একটি প্রণাম করিয়া সে বিদায় লইল।

রায় বলিলেন, মিত্তির, একখানা নতুন ফৌজদারী আইনের বইয়ের জন্যে কলকাতায় লেখ দেখি, আমাদের অমলের মামাকেই লেখ, সে যেন দেখে ভাল বই যা, তাই পাঠায়। আমাদের খানা পুরনো অনেক দিনের।

চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া ঘরের মধ্যেই খানিকটা পায়চারি করিয়া বলিলেন, এক পা যদি বিরোধের দিকে এগোয়, সঙ্গে সঙ্গে কালীর বুকে বাঁধ দিয়ে যে পাম্প বসিয়েছে মুখুজ্জে, সেটা বন্ধ করে দাও। চর-বন্দোবস্তির সঙ্গে নদীর কিছু নেই।

দ্বিপ্রহরে উপরের ঘরে প্রবেশ করিয়া ইন্দ্র রায় ডাকিলেন, হেমাঙ্গিনী!

স্বামীর এমন কণ্ঠস্বর হেমাঙ্গিনী অনেক দিন শুনেন নাই। দ্রুতপদে তিনি উপরে আসিয়া রায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, এই বয়েসে এতকাল পরে আবার অসময়ে আরম্ভ করলে? ছিঃ!

অর্থাৎ মদ। হেমাঙ্গিনীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রতারিত হয় নাই। রায় চিন্তা করিতে করিতেই দুই-এক পাত্র কারণ পান করিতেছেন। তাঁহার মুখ থমথমে রক্তাভ, সদ্য-ঘুমভাঙা ব্যক্তির মত।

রায় হাসিয়া বলিলেন , বড় চিন্তায় পড়েছি হেম , সামনে মনে হচ্ছে অগ্নিপরীক্ষা।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, মুখ দেখে তো তা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন কোন সুখবর পেয়েছ।

না না হেম, চরের কলের মালিকের সঙ্গে দাঙ্গা বাধবে বলে মনে হচ্ছে। লোকটা আজ শাসিয়ে লোক পাঠিয়েছিল। তোমায় একবার সুনীতির কাছে যেতে হবে। ব্যাপারটা তাকে জানানো দরকার। বলবে, কোন ভয় নেই তার, পেছনে নয়, আমি এবার সামনে।

* * *

মজুমদার ভারাক্রান্ত মন লইয়া সংবাদ দিতে চলিয়াছিল। নদীর ঘাটে আবার যখন সে নামিল, তখন ও-পারে বয়লারে বারোটার সিটি বাজিতেছে। কলরবে কোলাহলে চরটা মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে। এ-পার হইতে চরটাকে বিচিত্র মনে হয়। কালিন্দীর কালো জলধারার কূলে সবুজ আস্তরণের মধ্যে রাঙা পথের ছক, নূতন ঘরবাড়ি, মানুষের চাঞ্চল্য কোলাহল, কুলীদের গান-অদ্ভুত! চরটা যেন এক চঞ্চলা কিশোরীর মত কালিন্দীর জলদর্পণের দিকে চাহিয়া অহরহ প্রসাধনে মত্ত।

এ-পারে রায়হাট নিস্তব্ধ; সমস্ত গ্রামখানা প্রাচীন কালের গাছে গাছে আচ্ছন্ন। গাছগুলির মাথায় রাশি রাশি ধূলা, কয়খানা প্রাচীন কালের দালানের বিবর্ণ জীর্ণ চিলে-কোঠা কেবল গাছের উপর জাগিয়া আছে ধূলি-ধুসর জটার কুণ্ডলীর মত। ও-পারের চরটার তুলনায় মনে হয়, যেন কোন লোলচর্ম পলিতকেশা জরতী ঘোলাটে চোখের স্থিমিত অর্থহীন দৃষ্টি মেলিয়া পরপারের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছে নিস্পন্দ নির্বাক।

মজুমদার প্রত্যক্ষভাবে এমন করিয়া না বুঝিলেও ভারাক্রান্ত মনে ব্যাথা পাইল। সে যখন গিয়াছিল, তখন ইন্দ্র রায় ও চক্রবর্তীদের উপর ক্রোধবশতঃ রায়হাটকেও ঘৃণা করিয়াছিল, কিন্তু ফিরিবার পথে ইন্দ্র রায়ের সহৃদয়তার উত্তাপে তাহার মনে হইয়াছে অন্যরূপ, সে এবার রায়হাটের জন্য বেদনা অনুভব করিল। মাথা নীচু করিয়াই নদীর বালি ভাঙিয়া সে চলিতেছিল; সহসা চিলের মত তীক্ষ্ণ গলায় কে তাহাকে বলিল, কি রকম? কি হল মশায়? কি বললে চামচিকে পক্ষী, আড়াইহাজারী জমিদার?

মজুমদার মাথা তুলিল, সম্মুখে চর হইতে ফিরিতেছেন অচিন্ত্যবাবু, হরিশ রায়, শূলপাণি। প্রশ্নকর্তা তীক্ষ্ণকণ্ঠ অচিন্ত্যবাবু। বিমলবাবুর আশ্রয় করিবার পর হইতেই অচিন্ত্যবাবু ইন্দ্র রায়ের নামকরণ করিয়াছেন, চামচিকা পক্ষী, আড়াইহাজারী জমিদার।

মজুমদার বলিল, ছিঃ অচিন্ত্যবাবু, রায় মহাশয় আমাদের এখানকার মানী লোক-

শূলপাণি আসিবার পূর্বেই গাঁজা চড়াইয়াছিল, সে বাধা দিয়া হাত নাড়িয়া বলিয়া উঠিল। মানী লোক! কে হে? ইন্দ্র রায়? মরে যাই আর কি! বলি, আমরাও তো জমিদার হে, আমরাই বা কি কম?

মজুমদার বলিল, দেখ শূলপাণি,যা-তা বাজে বকো না। তুমি মুখার্জি সাহেবের তাঁবেদার, আর রায় মশায় হলেন তোমার সাহেবের জমিদার।

অচিন্ত্যবাবু এককালে চাকুরিজীবী ছিলেন, মজুমদার তাঁহার অপেক্ষা উচ্চপদস্থ কর্মচারী–এ জ্ঞান তাঁহার টনটনে, তিনি ধাঁ করিয়া কথাটি ঘুরাইয়া লইয়া বলিলেন, কি বললেন রায় মশায়!

বললেন আর কি! যা বলবার তাই বললেন। বললেন, ‘বেগার ধরা আমাদের অনেক কালের অভ্যেস, ছাড়তে বললেই কি ছাড়া যায়?’ তারপর অবিশ্যি হাসতে হাসতেই বললেন যে, ‘ এ তো সাঁওতাল, চক্রবর্তী-বাড়িতে ক্রিয়াকর্ম হলে তোমাদের সাহেবকেও বেগার ধরব হে। কাজ তো অনেক রকম আছে।’

অচিন্ত্যবাবু পরম বিজ্ঞের মত ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে গম্ভীর ভাবে বলিলেন, লাগল তো হলে। এইবার কিন্তু রায় ঠকবেন। জমিদারী আর সাহেবী বুদ্ধিতে অনেক তফাত। মেয়ে-জামাইয়ের জন্যে এইবার রায় অপমানিত হবেন।

মজুমদার বলিল, না না, ও-কথাটা ঠিক নয় হে।

মানে?

আজ যা বললেন, তাতে বুঝলাম, ও বিয়ের কথাটা ঠিক নয়। বললেন আমাকে, ‘ও ছেলেমেয়ে থাকলেই কথা ওঠে যোগেশ, কিন্তু তা হলে কি তুমি জানতে পারতে না-চক্রবর্তী বাড়ির পুরোন কর্মচারী তুমি! তবে ভগবানের ইচ্ছে হয়, হবে।’

আপনার মাথা! অচিন্ত্যবাবু প্রচণ্ড অবজ্ঞাভরে সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, আপনার মাথা! আমি নিজে জানি, কথা উঠেছিল। রায়ের ছেলে অমল অহীন্দ্রকে পর্যন্ত ধরেছিল। এখন আসল ব্যাপার, রামেশ্বরবাবু আর ও বাড়ির মেয়ে ঘরে ঢোকাবেন না। এ যদি না হয়, আমার কানদুটো কেটে ফেলব আমি। ভগবানের ইচ্ছে হয়, হবে! শাক দিয়ে মাছ ঢাকা আর কি!-বলিয়া তিনি হেঁ-হেঁ করিয়া হাসিতে আরম্ভ করিলেন-বিজ্ঞতার হাসি।

হরিশ রায়ের চোখ দুইটি বিস্ফারিত হইয়া উঠিল। ভ্রূ দুইটি ঘন ঘন নাচিতে আরম্ভ করিল, ঘাড়টি ঈষৎ দোলাইয়া বলিয়া উঠিলেন, অ্যাই ঠিক কথা। অচিন্ত্যবাবু ঠিক ধরেছেন।

শূলপাণি বার বার ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হুঁ-হুঁ, সে বাবা কঠিন ছেলে, রামেশ্বর চক্রবর্তী, আর কেউ নয়। তারপর হি-হি করিয়া হাসিয়া অদৃশ্য ইন্দ্র রায়কে সম্বোধন করিয়া ব্যঙ্গ ভরে বলিল, লাও বাবা, লাও, মেয়ে-জামাইয়ের জন্যে চরের ওপর লগর বসাও!

কথাটা মজুমদারেরও মনে ধরিল। ইন্দ্র রায়ের সহৃদয়তার যে সাময়িক কোমলতা তাহার জাগিয়াছিল, কুয়াশার মত সেটা তখন মিলাইয়া যাইতে আরম্ভ করিয়াছে।

হরিশ রায় চুপি চুপি বলিলেন, এই দেখ আমাদের জ্ঞাতি হলে হবে কি, ছোট রায়-বাড়ির ওই কেলেঙ্কারী, যাকে বলে বংশগত, তাই। আমাদের কাছে রায়বংশের কুর্সীনামা আছে, দেখিয়ে দোব, প্রতি পুরুষে ওদের এই কেচ্ছা, বুঝেছ?

সেই দু’পহরের রৌদ্র মাথায় করিয়া নদীর বালির উপরেই তাহাদের মজলিস জমিয়া উঠিল। সকলেরই মনোভাণ্ডে পরনিন্দার রস রৌদ্রতপ্ত তাড়ির মতই ফেনাইয়া গাঁজিয়া উঠিয়াছে।

সন্ধ্যা না হইতেই কথাটা গ্রামময় রটিয়া গেল।

ছোট রায়-বাড়ির কাছারি পর্যন্ত কথাটা আসিয়া পৌঁছিয়া গেল। ইন্দ্র রায় কাছারিতে ছিলেন না, অন্দরে নিয়মিত সন্ধ্যা-তর্পণে বসিয়াছিলেন; কথাটা প্রথম শুনিলেন রায়ের নায়েব মিত্তির। পথের উপর দাঁড়াইয়া অতিমাত্রায় ইতরতার সহিত রায়-বংশের নিঃস্ব নাবালকটির সেই অভিভাবিকা উচ্চকণ্ঠে কথাটা ঘোষণা করিতেছিল। মিত্তিরের সর্বাঙ্গে যেন জ্বালা ধরিয়া গেল, কোন উপায় ছিল না, ঘোষণাকারিণী স্ত্রীলোক। রায়কে কথাটা শুনাইতেও তাহার সাহস হইল না। সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

রায়ের সন্ধ্যা-উপাসনা তখন অর্ধসমাপ্ত, দ্বিতীয় পাত্র কারণ পান করিয়া জপে বসিয়াছেন। গদ্গদস্বরে ইষ্টদেবীকে বার বার ডাকিতেছেন, মা আমার রণরঙ্গিনী মা! ধনী মুখার্জির সহিত দ্বন্দসম্ভাবনায় বহুকাল পরে গোপন ও উত্তেজনাবশে আজ ওই রূপ ওই নামটিই তাহার কেবল মনে পড়িতেছে।

সহসা বাড়ির উঠানে কাংস্যকণ্ঠে কে চীৎকার শুরু করিয়া দিল, হায় হায় গো! মরে যাই, মরে যাই! আহা গো! ‘পিড়ি পেতে করলাম ঠাঁই, বাড়া ভাতে পড়ল ছাই।’ দিলে তো চক্কবর্তীরা ঝামা ঘষে? হয়েছে তো? নাবালক শরিককে ফাঁকি দেওয়ার ফল ফলল তো? ঈর্ষাতুরা মেয়েটির পথে পথে চীৎকার করিয়াও তৃপ্তি হয় নাই, সে রায়ের অন্দরে আসিয়া হেমাঙ্গিনীর সম্মুখে হাত নাড়িয়া কথাগুলি শুনাইতেছে।

রায়ের ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, পরক্ষণেই আপনাকে তিনি সংযত করিলেন, ধীর স্থির ভাবে ইষ্ট দেবীকে স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন।

নীচে হেমাঙ্গিনীর মুখের কাছে হাত নাড়িয়া ভঙ্গি সহকারে নাবালকের অভিভাবিকাটি তখনও বলিতেছিল, তাই বলতে এলাম, বলি, একবার বলে আসি। আমার নাবালককে যে ফাঁকি দেবে, ভগবান তাকে ফাঁকি দেবে। আঃ, হায় হায় গো! হায় হায়! সে যেন নাচিতে আরম্ভ করিল।

হেমাঙ্গিনী ব্যাপারটার আকস্মিকতায় এবং রূঢ়তায় অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল, শঙ্কায় বিস্ময়ে কম্পিত মৃদুকণ্ঠে তিনি বলিলেন, কি বলছ তুমি?

ইতর ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ করিয়া বিধবাটি বলিল, আ মরে যাই! কিছু জানেন না কেউ! বলি, চক্কবর্তী-বাড়ির রাঙা বর জুটল না তো মেয়ের কপালে? দিয়েছে তো চক্কবর্তীরা হাঁকিয়ে? বলি, কোন মুখে তোরা আবার গিয়েছিলি তাই শুনি? এই বাড়ির মেয়ে নাকি আবার চক্কবর্তীরা নেয়! বলে যে, সেই-‘মিনসে নেয় না বসতে পাশে, মাগী বলে আমায় ভালবাসে’ সেই বিত্তান্ত। আঃ হায় হায় গো! ফসকে গেল এমন সুযোগ! অকস্মাৎ তাহার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত রূঢ় হইয়া উঠিল, যা চর ঢুকিয়ে দিগে চক্কবর্তীদের বাড়িতে! মেয়ে-জামায়ের জন্য লগর বসালেন! আঃ হায় হায়! হায় হায় গো!

সে যেমন নাচিতে নাচিতে আসিয়াছিল তেমনি নাচিতে নাচিতেই চলিয়া গেল। চৈতন্যহারা হেমাঙ্গিনী মাটির পুতুলের মতই বসিয়া রহিলেন। উপর হইতে গভীর দীর্ঘ কণ্ঠের ধ্বনি ভাসিয়া আসিল, তারা, তারা মা। সমস্ত বাড়িটার মধ্যে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনির মত ঝঙ্কারে সুগভীর হইয়া বাজিয়া উঠিল।

কিছুক্ষণ পর সিঁড়ির উপরে খড়মের শব্দ ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সন্ধ্যা-উপসনার পর বিশেষ প্রয়োজন না হইলে রায় নীচে নামেন না। আজ রায় নীচে নামিলেন, হেমাঙ্গিনী কিন্তু তবুও সচেতন হইয়া উঠিতে পারিলেন না। রায় নীচে নামিয়া ডাকিলেন, হেম! এ ডাক তাঁহার আদরের ডাক।

হেমাঙ্গিনী সাড়া দিতে পারিলেন না। রায় বলিলেন, উঠতে হবে যে হেম। উঠে একখানা ভাল কাপড় পর দেখি। আমার শালখানাও বের করে দাও।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া হেমাঙ্গিনী এবার উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রায় বলিলেন, একটু শিগগির কর হেম, মাহেন্দ্রযোগ খুব বেশিক্ষণ নেই।

হেমাঙ্গিনী এতক্ষণে প্রশ্ন করিলেন, কোথায় যাবে?

হাসিয়া রায় বলিলেন, মা আমার আজ অনুমতি দিয়েছেন হেম। যাব রামেশ্বরের কাছে, উমার বিয়ের সম্বন্ধ করতে। ভাল কাপড় পর একখানা, আমার শালখানাও দাও।

হেমাঙ্গিনীর মুখ এবার উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, সোনার উমা, সোনার অহীন্দ্র তাঁহার। গোপন মনে এ-কথা তাহার কত বার মনে হইয়াছে।

চাকর চলিয়াছিল আলো লইয়া, চাপরাসী ছিল পিছনে।

সুদীর্ঘ কাল পরে ইন্দ্র রায় চক্রবর্তী-বাড়ির দুয়ারে আসিয়া ডাকিলেন, কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া উঠিল, রামেশ্বর!

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনির মতই একটা ধ্বনি ভাসিয়া আসিল, কে? বিচিত্র সে কণ্ঠস্বর!

রায় উত্তর দিলেন, আমি ইন্দ্র।