We make 🌍 Biggest bengali library @ 🚅 speed please wait some⏳️
Posts

৬) কালিন্দী – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

সমস্ত গ্রামে রটিয়া গেল, রামেশ্বর চক্রবর্তীর ছোট ছেলে অহীন্দ্র ইন্দ্র রায়ের নাক কাটিয়া ঝামা ঘষিয়া দিয়াছে; ইন্দ্র রায় সাঁওতালদের আটক করিয়া রাখিয়াছিলেন, অহীন্দ্র জোর করিয়া তাহাদের উঠাইয়া লইয়া আসিয়াছে। রটনার মূলে ওই অচিন্ত্যবাবুটি! তিনি একটু আড়ালে দাঁড়াইয়া দূর হইতে যতটা দেখা ও শোনা যায়, দেখিয়া শুনিয়া গল্পটি রচনা করিয়াছিলেন। তিনি প্রচণ্ড একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামার কল্পনা করিয়া সভয়ে স্থানত্যাগ করিয়াও নিরাপদ দূরত্বের আড়ালে থাকিয়া ব্যাপারটা দেখিবার লোভ সংবরণ করিতে পারেন নাই।

সাময়িক দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়া ইন্দ্র রায়ও লজ্জিত হইয়াছিলেন। মুহূর্তের দুর্বলতার জন্য সকলে তাঁহার মাথায় যে অপমানের অপবাদ চাপিয়া দিল, সে অপবাদ সংশোধন করা এখন কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। চক্রবর্তী-বাড়ির বড়ছেলে মহীন্দ্র এবং বিচক্ষণ নায়েব যোগেশ মজুমদার আসিয়া পৌঁছিয়া গিয়াছে। কাল রাত্রেই আসিয়া পৌঁছিয়াছে। আজ প্রাতঃকালে তাঁহার লোক সাঁওতাল-পাড়ায় গিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আজ চক্রবর্তী-বাড়ির নায়েব সাঁওতালপাড়ায় বসে রয়েছেন, লোকজনও অনেকগুলি রয়েছে। আমরা সাঁওতালদের ডাকলাম, তাতে ওঁদের নায়েব বললেন, আমি ওদের সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি, বলগে বাবুকে।

ইন্দ্র রায় গম্ভীর মুখে মাথা নত করিয়া পদচারণা আরম্ভ করিলেন, মনে মনে নিজেকেই বার বার ধিক্কার দিতেছিলেন। তিনি দিব্যচক্ষে দেখিলেন, ও-পারের চর ও তাঁহার মধ্যে প্রবহমাণা কালিন্দী অকস্মাৎ আকূল পাথার হইয়া উঠিয়াছে। কিছুক্ষণ পরেই মজুমদার আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহার পিছন পিছন সাঁওতালরাও আসিয়া প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। মজুমদার রায়কে প্রণাম করিয়া বলিল, ভাল আছেন?

রায় ইষৎ হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ। তার পর বলিলেন, কি রকম? আবার নাকি চক্রবর্তীরা সাঁওতালদের নিয়ে দেশ জয় করবে

শুনছি?

তাঁহারই কথার কৌতুকে হাসিতেছে, এমনি ভঙ্গিতে হাসিয়া মজুমদার বলিল, এসে শুনলাম সব। তা আমাদের ছোটবাবু অনেকটাই ওঁর পিতামহের মত দেখতে, এটা সত্যি কথা।

রায় ঠোট দুইটি ঈষৎ বাঁকাইয়া বলিলেন, তা সাঁওতালবাহিনী নিয়ে লড়াইটা প্রথম আমার সঙ্গেই করবে নাকি তোমরা?

লজ্জায় জিভ কাটিয়া মজুমদার বলিয়া উঠিল, রাম রাম রাম, এই কথা কি হয়, না হ’তে পারে? তা ছাড়া আপনার অসম্মান কি কেউ এ-অঞ্চলে করতে পারে বাবু?

রায় চুপ করিয়া রহিলেন, মজুমদার আবার বলিল, সেই কথাই হচ্ছিল কাল ওবাড়ির গিন্নীঠাকরুনের সঙ্গে। তিনি বলিলেন, এ-বিবাদ গ্রাম জুড়ে বিবাদ। এখনও কেউ এগোয় নি বটে, কিন্তু বিবাদ আরম্ভ হ’লে কেউ পেছিয়ে থাকবে না। আমি সেইজন্যে অহিকে ও-বাড়ির দাদার কাছে পাঠিয়েছিলাম। কাল তুমি একবার যাবে মজুমদার ঠাকুরপো, বলবে, তাঁর মত লোক বর্তমান থাকতে যদি এখন গ্রামনাশা বিবাদ বেঁধে ওঠে, তবে তার চেয়ে আর আক্ষেপের বিষয় কিছু হ’তে পারে না।

রায় শুধু বলিলেন, হুঁ।

মজুমদার আবার বলিল, আমাদের বড়বাবু— মহীন্দ্রবাবু একটু তেজিয়ান; অল্প বয়স তো! তিনি অবশ্য বলছিলেন, মামলা-মকদ্দমাই হোক; যার ন্যায্য হবে, সেই পাবে চর। আমাকেও বললেন, সাঁওতালদের কারও ডাকে যেতে নিষেধ করতে। কিন্তু গিন্নী-ঠাকরুন বললেন, তাই কখনও হতে পারে? আর আমাদের অহীন্দ্রবাবু তো অন্য প্রকৃতির ছেলে, তিনি বললেন, তা হ’তে পারে না দাদা, আমি মামাকে বলে তাদের ছুটি করিয়ে দিয়েছি। কড়ার করে ছুটি করিয়ে দিয়েছি, তিনি ডাকলেই ওদের যেতে হবে। আমি নিজে ওদের ওখানে হাজির করে দেব। তিনি নিজেই আসতেন, তা আজ স্কুল খুলবে, ভোরেই চলে গেলেন শহরে।

রায় একটু অন্যমনস্ক হইয়া উঠিলেন, এই ছেলেটি তাঁহার কাছে যেন একটা জটিল রহস্যের মত হইয়া উঠিয়াছে। আজ সমস্ত সকালটাই তিনি ওই ছেলেটির সম্পর্কে ভাবিয়াছেন, অদ্ভুত কুটবুদ্ধি ছেলেটির। সেদিনের মশালের আলো জ্বালিয়া সে যখন যায়, তখনও তিনি সেই কথাই ভাবিতেছিলেন। কিন্তু প্রত্যেক বারই ছেলেটি তাঁহাকে লজ্জিত করিয়া সহাস্যমুখে আসিয়া দাঁড়াইতেছে।

মজুমদার বলিল, আপনার মত ব্যক্তিকে আমার বেশী বলাটা ধৃষ্টতা। গ্রাম জুড়ে বিবাদ হ’লে তো মঙ্গল কারু হবে না। এদিকে কাগজপত্র, কার কি স্বত্ব, এখানকার সমস্ত হাল হদিস আপনার নখদর্পণে, আপনিই এর বিচার করে দিন।

রায় বলিলেন, রামেশ্বরের ছোট ছেলেটি সত্যিই বড় ভাল ছেলে। ক্ষুরের ধারের মত স্বচ্ছন্দে কেটে চলে, কোথাও ঠেকে যায় না। ছেলেটি ওদের বংশের মতও নয় ঠিক, চক্রবর্তীবংশের চুল কটা, চোখ কটা, কিন্তু গায়ের রংটা তামাটে। এ ছেলেটি বোধ হয় মায়ের রং পেয়েছে, না হে?

মজুমদার বলিল, হ্যাঁ, গিন্নী-ঠাকরুন আমাদের রূপবতী ছিলেন এক কালে, আর প্রকৃতিতেও বড় মধুর। ছেলেটি মায়ের মতই বটে, তবে আমাদের কর্তাবাবুর বাপের রং ছিল এমনি গৌরবর্ণ!

হ্যাঁ, সাঁওতালেরা সেইজন্যেই তাঁর নাম দিয়েছিল-রাঙাঠাকুর। একেও নাকি সাঁওতালেরা নাম দিয়েছে-রাঙাবাবু?

মাঝির দল এতক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, এবার সর্দার কমল মাঝি বলিল, হুঁ, আমি দিলাম সি নামটি। রাঙাঠাকুরের লাতি, তেমূনি আগুনের পারা গায়ের রং-তাথেই আমি বললাম, রাঙাবাবু।

রায় গম্ভীরভাবে চুপ করিয়া রহিলেন, সাঁওতালের কথার উত্তর তিনি দিলেন না। সুযোগ পাইয়া মজুমদার আবার বর্তমান প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া বলিল, তা হ’লে সেই কথাই হ’ল। গ্রামের সকল শরিককে ডেকে চণ্ডীমণ্ডপে বসে এর মীমাংসা হয়ে যাক। চর যাঁর হবে তিনিই খাজনা নেবেন ওদের কাছে। ওরা এখন যাক্‌।গরীব দুঃখী লোক, যতক্ষণ খাটবে ততক্ষণ ওদের অন্ন। -বলিয়া রায় কোন কথা বলিবার পূর্বেই মজুমদার মাঝিদের বলিয়া দিল, যা, তাই তোরা এখন বাড়ি গিয়ে আপন আপন কাজকর্মে করগে। আমরা সব নিজেরা ঠিক করি কে খাজনা পাবে, তাকেই তোরা কবুলতি দিবি, খাজনা দিবি।

মাঝির দল প্রণাম করিয়া তাহাদের নিজস্ব ভাষায় বোধ করি এই প্রসঙ্গ লইয়াই কলকল করিতে করিতে চলিয়া গেল। রায় গম্ভীর মুখে একই দিকে দৃষ্টি রাখিয়া বসিয়া ছিলেন বসিয়া রহিলেন। সাঁওতালের দল বাহির হইয়া গেলে তিনি বলিলেন, সেই ভাল মজুমদার, ও বেচারাদের কষ্ট দিয়ে লাভ কি, যাক ওরা। আগে এই বিবাদের মীমাংসাই হয়ে যাক-

আজ্ঞে হ্যাঁ, একদিন গ্রামের সমস্ত শরিককে ডেকে-

বাধা দিয়া রায় বলিলেন, শরিকরা তো তৃতীয় পক্ষ, সর্বাগ্রে হোক ছোট তরফ আর চক্রবর্তীদের মধ্যে।

বেশ, তাই হোক। একদিন প্রমাণ-প্রয়োগ দেখুন, তাতে যা বলে দেবেন, তাই হবে।

না। একদিন প্রমাণী লাঠি প্রয়োগ করে, তাতে শক্তিতে যার হবে, সেই নেবে চর। তারপর মামলা-মকদ্দমা পরে কথা।

হাতজোড় করিয়া মজুমদার বলিল, না না বাবু, এ কথা কি আপনার মুখে সাজে? আপনি হলেন ও-বাড়ির মুরব্বী; ছেলেদের-

বাধা দিয়া রায় বলিলেন, ও কথা ব’লো না মজুমদার। বার বার আমায় অপমান তুমি ক’রো না। ওকথা মনে পড়লে আমার বুকের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে।

মজুমদার স্তব্ধ হইয়া গেল; কিছুক্ষণ পর আবার সবিনয়ে বলিল, আপনি বিজ্ঞ বিবেচক ব্যক্তি, বড়লোক; আপনার চাকর বলেই সাহস করে বলছি, এ আগুন কি জ্বেলে রাখা ভাল বাবু?

অস্থির হইয়া বার বার ঘাড় নাড়িয়া রায় বলিল, রাবণের চিতা মজুমদার ও নিববে না, নেববার নয়।

মজুমদার আর কথা না বাড়াইল না, তাহার চিত্তও ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। আপন প্রভুবংশের মানমর্যাদা আর সে খাটো করিতে পারিল না, সবিনয়ে হেঁট হইয়া রায়কে প্রণাম করিয়া এবার বলিল, আজ্ঞে বেশ। আপনি যেমন আদেশ করলেন, তেমনি হবে।

রায় বলিলেন, ব’সো। বেলা অনেক হয়েছে, একটু শরবৎ খেয়ে যাও। না খেলে আমি দুঃখ পাব মজুমদার।

মজুমদার আবার আসন গ্রহণ করিয়া বলিল, আজ্ঞে, এ তো আমার চেয়ে খাবার ঘর।

মজুমদার চলিয়া গেল। রায় গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া গেলেন। কুক্ষণে অহীন্দ্র তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। রাধারাণীর সুপ্ত স্মৃতি সুপ্তি ভাঙিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে চক্রবর্তীদের উপর দারুণ আক্রোশে ও ক্রোধে তিনি ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছেন। রামেশ্বরের মস্তিষ্কবিকৃতি দৃষ্টি রুগ্ন হওয়ার পর তিনি শান্ত হইয়াছিলেন। আবার ওই চর উপলক্ষ্য করিয়া অহীন্দ্র তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই সে আক্রোশ আবার জাগিয়া উঠিয়াছে। রাধারাণীর সপত্নীপুত্রের জন্য তিনি পথ ছাড়িয়া দিবেন? আজ এই ছেলেটি যদি রাধারাণীর হইত, তবে অমনি দ্বন্দের অভিনয় করিয়া তিনি গোপনে হাসিতে হাসিতে পরাজয় স্বীকার করিয়া ঘরে ঢুকিতেন। লোকে বলিত ইন্দ্র রায় ভাগিনেয়ের কাছে পরাজিত হইল। এ ক্ষেত্রে, পরাজয়ে রাধারাণীর গৃহত্যাগের লজ্জা দ্বিগুণিত হইয়া লোকসমাজে তাঁহার মাথাটা ধুলায় লুটাইয়া দিবে। আর তাঁহার সরিয়া দাঁড়ানোর অর্থই হইল রাধারাণীর সপত্নীপুত্রের পথ নিষ্কন্টক করিয়া দেওয়া।

অচিন্ত্যবাবু রায়বাড়ির ভিতর হইতেই বাহির হইয়া আসিলেন। রায়ের দশ বৎসরের কন্যা উমাকে তিনি পড়াইয়া থাকেন। উমাকে পড়াইয়া কাছারিতে আসিয়া রায়ের সম্মুখে তক্তপোশটার উপর বসিয়া বলিলেন, চমৎকার একটা প্ল্যান করে ফেলেছি রায় মশায়। দেশী গাছ গাছড়া সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। চরটার ওপর নাকি হরেক রকমের গাছগাছড়া আছে। যা শুনলাম, তাতে শতকরা দু’শ লাভ। দেখবেন নাকি হিসেবটা?

থাক এখন।

আচ্ছা, থাক। আর ভাবছি, পাঁচ রকম মিশিয়ে অম্বলের ওষুধ একটা বের করব। বাংলাদেশে এখন অম্বলটাই, মানে ডিস্‌পেপ্‌ সিয়াটাই হ’ল প্রধান রোগ।

রায় ওকথা গ্রাহ্যই করিলেন না, তিনি ডাকিলেন নায়েবকে, মিত্তির! একবার ননীচোরা পালকে তলব দাও তো, বল জরুরী দরকার। আর-আচ্ছা, আমিই যাচ্ছি ভেতরে। রায় উঠিয়া কাছারি-ঘরের ভিতর চলিয়া গেলেন। নায়েবকে বলিলেন, দুখানা ডেমিতে একটা বন্দোবস্তির পাট্টাকবুলতি করে ফেল। আমরা ননী পালকে কুড়ি বিঘে চর বন্দোবস্ত করছি। ননী আমাদের বরাবর কবুলতি দিচ্ছে।

নায়েব বলিল, যে আজ্ঞে।

ননী পাল একজন সর্বস্বান্ত চাষী। দাঙ্গা-হাঙ্গামায়, ফৌজদারি মকদ্দমায় তাহার যথাসর্বস্ব গিয়াছে, জেলও সে কয়েকবার খাটিয়াছে। এখন করে পানবিড়ি-মুড়ি-মুড়কির দোকান। লোকে বলে, চোরাই মালও নাকি সে সামলাইয়া থাকে, বিশেষ করিয়া চোরাই ধান। একবার দারোগার নাকে কিল মারিয়া সে তাহার নাকটা ভাঙিয়া দিয়াছিল, একবার দুই আনা ধারের জন্য রায়েদেরই ফুলবাড়ির একটি ছেলের সহিত বচসা করিয়া তাহার কান দুইটা মলিয়া দিয়া বলিয়াছিল, এতেই আমার দুআনা শোধ হ’ল। এমনি প্রকৃতির লোক ননীচোরা পাল। রায় কন্টক দিয়া কন্টক তুলিবার ব্যবস্থা করিলেন। বিশ বিঘা জমির জন্য তাঁহাকে জমিদার স্বীকার করিয়া চক্রবর্তীদের সহিত বিবাদ করিতে ননী বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিবে না।

এই লইয়া আরও দুই-চারিটি কথা বলিয়া রায় বাহিরে আসিলেন। অচিন্ত্যবাবু তখন কাছারি-বাড়ি হইতে বাহির হইয়া যাইতেছিলেন, রায় বলিলেন, চললেন যে?

অচিন্ত্যবাবু সংক্ষেপে বলিলেন, হ্যাঁ।

রায় হাসিয়া বলিলেন, বসুন বসুন, আপনার প্ল্যানটা শোনা যাক।

আজ্ঞে না, দুর্জন আসবার আগেই স্থান ত্যাগ করা ভাল। ননী পালটা বড় সাংঘাতিক লোক। ব্যাটা মেরে বসে!

পাগল নাকি আপনি? দেখছেন, দেওয়ালে কখানা তলোয়ার ঝুলছে?

শিহরিয়া উঠিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, খুলে ফেলুন, খুলে ফেলুন, ওগুলো বড় সাংঘাতিক জিনিস। বাঙালির হাতে অস্ত্র, গভর্মেন্ট অনেক বুঝেই আইন ক’রে কেড়ে নিয়েছে। ওগুলোর লাইসেন্স আছে তো আপনার?

বলিতে বলিতেই তিনি বাহির হইয়া গেলেন। অল্পক্ষণ পরেই কন্যা উমা আপন মনেই হারাধনের দশটি ছেলের ছড়া বলিতে বলিতে আসিয়া ওই ছড়ার সুরেই বলিল, বাবা, আপনাকে মা ডাকছেন, বেলা অনেক হয়েছে স্নান করুন। -বলিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। আবার হাসি থামাইয়া গম্ভীরভাবে বলিল, কানে কানে একটা কথা বলি বাবা।

উমা মেয়েটি একটু তরঙ্গময়ী। রায় তাহার মুখের কাছে কান পাতিয়া দিলেন। সে ফিসফিস করিয়া বলিল, প-অন্তস্থায়- দন্ত্য সয়ে আকার।

হাসিয়া রায় বলিলেন, আচ্ছা আচ্ছা হচ্ছে। তুমি বাড়ির মধ্যে চল, আমার যেতে একটু দেরি হবে, তোমার মাকে বল গিয়ে।

উমা প্রশ্ন করিল, কয়ে একার দন্ত্য ন?

কাজ আছে মা।

না, চলুন আপনি।

ছি! ওরকম করে না, কাজ আছে শুনছ না? ওই দেখ লোক এসেছে কাজের জন্যে।

ননী পাল আসিয়া একটি সংক্ষিপ্ত প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। বেঁটেখাটো লোকটি, লোহার মত শক্ত শরীর, চওড়া কপালের নীচেই নাকের উপর একটা খাঁজ; ওই খাঁজটা একটা নিষ্ঠুর হিংস্র মনোভাব তাহার মুখের উপর ফুটাইয়া তুলিয়াছে।

গ্রামে কিন্তু ততক্ষণে ননী পালকে জমি-বন্দোবস্তের সংবাদ রটিয়া গিয়াছে। অচিন্ত্যবাবু গাছগাছড়ার ব্যবসার কল্পনা পরিত্যাগ করিয়া ফেলিয়াছেন। -সর্বনাশ, চরের উপর ব্যাটা কোন্‌ দিন খুন ক’রেই দেবে আমাকে।

* * *

হেমাঙ্গিনী স্বামীর জন্য প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া ছিলেন। কাজ শেষ করিয়া স্নান সারিয়া রায় যখন ঘরে প্রবেশ করিলেন, তখন প্রায় দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে। স্বামীর পূজা-আহ্নিকের আসনের পাশে বসিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া হেমাঙ্গিনী কি যেন ভাবিতেছিলেন। রায়কে দেখিয়া বলিলেন, এত বেলা কি করে! খাবেন কখন আর?

রায় পত্নীর মনোরঞ্জনের জন্যই অকারণে একটু হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, দেরি একটু হয়ে গেল। জরুরী কাজ ছিল একটা।

বেশ, স্নান-আহ্নিক সেরে নাও দেখি আগে। এখন পর্যন্ত বাড়ির কারও খাওয়া হয় নি। উমাই কেবল খেয়েছে।

স্নান সারিয়া রায় আহ্নিকে বসিলেন। তারা, তারা মা!

আহারাদির পর শয্যায় শুইয়া গড়গড়ায় মৃদু মৃদু টান দিতেছিলেন। সমস্ত বাড়িটা একরূপ নিশ্চিন্ত হইয়াছে। বাহিরে চৈত্রের রৌদ্র তরল বহ্ন্যুত্তাপের মত অসহ্য না হইলেও প্রখর হইয়া উঠিয়াছে, পাখিরা এখন হইতেই এ সময় ঘনপল্লব গাছের মধ্যে বিশ্রাম শুরু করিয়া দিয়াছে। বাড়ির বারান্দায় মাথায় ঘুলঘুলিতে বসিয়া পায়রাগুলি গুঞ্জন করিতেছে। মধ্যে মধ্যে রুদ্ধদ্বার জানলায় খড়খড়ি দিয়া উত্তপ্ত এক-একটা দমকা বাতাস আসিতেছে; উত্তপ্ত বাতাসের মধ্যে বয়রা ও মহুয়া ফুলের উগ্র মাদক গন্ধ। বাহিরে ঝরঝর সরসর শব্দে বাতাসে ঝরা পাতা উড়িয়া চলিয়াছে। সূর্য আর পবন দেবতার খেলা চলিতেছে বাহিরে। দুইটি কিশোরের মিতালির লীলা।

হেমাঙ্গিনী ভাঁড়ারে ও লক্ষ্মীর ঘরে চাবি দিয়া আসিয়া স্বামীর শয্যার পার্শ্বে বসিলেন। রায় প্রশ্ন করিলেন, সারা হ’ল সব?

হ’ল।

খুব ক্ষিদে পেয়েছিল, তোমার, না?

হ্যাঁ, খুব। মনে হচ্ছিল, বাড়ির ইট-কাট ছাড়িয়ে খাই-হ’ল তো?

রায় হাসিয়া বলিলেন, রাগটুকু আছে খুব!

গেমাঙ্গিনী বলিলেন, দেখ, একটা কথা বলছিলাম।

বল।

ব’লছিলাম, আর কেন?

রায় ওইটুকুতেই সব বুঝিলেন, তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া পাশ ফিরিয়া শুইলেন, কোন উত্তর দিলেন না। রামেশ্বরের প্রতি হেমাঙ্গিনীর স্নেহের কথা তিনি জানেন। সে স্নেহ হেমাঙ্গিনী আজও ভুলিতে পারেন নাই।

হেমাঙ্গিনী একটু অপ্রতিভের মতই বলিলেন, মুখ ফিরিয়ে শুলে যে? ভাল, ও কথা আর বলব না! এখন আর একটা কথা বলি, শোন। এটা আমার না বললেই নয়।

না ফিরিয়াই রায় বলিলেন, বল।

দৃঢ়তার সহিত হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বিবাদ করবে, কর, কিন্তু অন্যায় অধর্ম তুমি করতে পাবে না। আমার অনেকগুলি সন্তান গিয়ে অবশিষ্ট অমল আর উমা; ওদের অমঙ্গল আমি হ’তে দিতে পারব না।

রায় এবার সঙ্কুচিত হইয়া পড়িলেন। তাঁহার কয়েকটি সন্তানই শৈশব অতিক্রম করিয়া বালক হইয়া মারা গিয়াছে। তাহাদের অকাল-মৃত্যুর হেতু বিশ্লেষণ করিতে বসিয়া হেমাঙ্গিনী যখন তাহার পাপপুণ্যের হিসাব করিতে বসেন, তখন তাঁহার মাথাটা যেন মাটিতে ঠেকিয়া যায়।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, আমাকে ছুঁয়ে তুমি শপথ কর, কোন অন্যায় অধর্ম তুমি করবে না?

রায় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, কেন তুমি প্রতি কাজে ওই কথা স্মরণ করিয়ে দাও, বল তো?

রুদ্ধকণ্ঠে হেমাঙ্গিনী বলিলেন, এতগুলো সন্তান যাওয়ার দুঃখ যে রাবণের চিতার মত আমার বুকে জ্বলছে। তুমি ভুলেছ, কিন্তু আমি তো ভুলতে পারি না। তাই তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হয়।

রায় উঠিয়া বসিলেন, জানলাটা খুলে দাও দেখি। বেলা বোধ হয় পড়ে এল।

হেমাঙ্গিনী জানলা খুলিয়া দিলেন, রোদ অনেকটা পড়িয়া আসিয়াছে, পাখিরা থাকিয়া থাকিয়া সমবেত স্বরে ডাকিয়া উঠিতেছে, বিশ্রাম তাহাদের শেষ হইয়া গেল- এ ইঙ্গিত তাহারই। রায় জানলা দিয়া নদীর ও-পারে ওই চরটার দিকে চাহিয়া ভাবিতে ছিলেন ওই কথাই। অমল-উমা, রাধারানী-রামেশ্বর, রায়-বাড়ি। এ কি দ্বিধার মধ্যে তাঁহাকে টানিয়া আনিয়া নিক্ষেপ করিল হেমাঙ্গিনী!

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বল।

রায় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তাই হবে। তিনি স্থির করিলেন, অপরাহ্নেই ননীকে ডাকাইয়া পাট্টা কবুলতি স্বহস্তে নাকচ করিয়া দিবেন।

হেমাঙ্গিনী চোখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া গেলেন, বোধ করি আবেগ তাঁর ধৈর্য্যের কূল ছাপাইয়া উঠিতে চাহিতেছিল। রায় নীরবে ওই চরের দিকে চাহিয়াই বসিয়া রহিলেন। মনটা কেমন উদাস হইয়া গিয়াছে। দীপ্ত সূর্যালোকের কালীর বালি ঝিকমিক করিতেছে। চরের উপরে বেনাঘাস দমকা বাতাসে হাজার হাজার সাপের ফণার মত নাচিতেছে। আকাশ ধূসর। এত বড় প্রান্তরের মধ্যে কোথাও একটা মানুষ দেখা যায় না। অথচ মাটি লইয়া মানুষের কাড়াকাড়ি সেই সৃষ্টির আদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে, কোন কালেও বোধ করি এ কাড়াকাড়ির শেষ হইবে না। নাঃ, ভাল বলিয়াছে হেমাঙ্গিনী-কাজ নাই; রায়হাটের সঙ্গে রায়বাড়ি না হয় কালীর গর্ভেই যাইবে। ক্ষতি কি!

হেমাঙ্গিনী ফিরিয়া আসিলেন, অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিকভাবে বলিলেন, অমলকে টাকা পাঠিয়েছ?

অমল মামার বাড়িতে থাকিয়া পড়ে। রায় অন্যমনস্কভাবেই বলিলেন, পাঠিয়েছি।

দেখ।

বল।

এ দিকে ফিরেই চাও। দোষ তো কিছু করি নি আমি।

অল্প একটু হাস্যের সহিত মুখ ফিরাইয়া রায় বলিলেন, না, তুমি ভালই বলেছ। আর কি হুকুম, বল?

উমাকে আমি দাদার ওখানে পাঠিয়ে দেব। শহরে থেকে একটু লেখাপড়া শিখবে, একটু সহবৎ শিখবে। জামাই আমি ভাল করব। এখানে থাকলে গেঁয়ো মেয়ের মত ঝগড়া শিখবে, আর যত রাজ্যের পাকামো।

রায় বলিলেন, হ্যাঁ, রায়-বাড়ির মেয়ের অখ্যাতিটা আছে বটে। তাঁহার মুখে এক বিচিত্র করুণ হাসি ফুটিয়া উঠিল। মনে পড়িয়া গেল সেদিনের কথা, রামেশ্বরের পিতামহী বলিয়াছিলেন রাধারানীর প্রসঙ্গে, রায়-বাড়ির মেয়ের ধারাই ওই, চিরকেলে জাঁহাবাজ!

হেমাঙ্গিনী স্বামীর মুখের দেখিয়া বুঝিলেন, স্বামী কথাটায় আহত হইয়াছেন, তিনি অপ্রতিভ হইয়া স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য ব্যাকুল হইয়া দুই হাতে তাঁহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, রাগ করলে?

পত্নীর কণ্ঠে সাদরে একখানি হাত ন্যস্ত করিয়া রায় তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, না না, তুমি সত্য কথা বলেছ।

প্রৌঢ়-দম্পতির উভয়ের চোখে অনুরাগভরা দৃষ্টি। কিন্তু সহসা চমকাইয়া উঠিয়া দুইজনেই পরস্পরকে ছাড়িয়া দিলেন। এ কি, এত গোলমাল কিসের? গ্রামের মধ্যে কোথাও একটা প্রচণ্ড কলরব উঠিতেছে! কোথাও আগুন লাগলো নাকি? রায় বিছানা ছাড়িয়া নামিয়া ব্যস্ত হইয়া কাপড় চোপড় ছাড়িতে আরম্ভ করিলেন।

কর্তাবাবু! -নীচে কে ডাকিল, নায়েব মিত্র বলিয়াই মনে হইতেছে।

কে? মিত্তির?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গোলমাল কিসের মিত্তি র?

আজ্ঞে, রামেশ্বরবাবুর বড় ছেলে মহীন্দ্রবাবু ননী পালকে গুলি ক’রে মেরে ফেলেছেন।

রায় কাপড় পরিতেছিলেন, সহসা তাঁহার হাত স্তব্ধ হইয়া গেল, তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে চাহিলেন। হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছিল, তিনি বলিলেন, তুমি করলে কি? ছি ছি!

রায় দ্রুতপদে নামিয়া গেলেন।