জৈষ্ঠের শেষে কয়েক পসলা বৃষ্টি হইয়া মাটি ভিজিয়া সরস হইয়া উঠিল। কয়েক দিনের মধ্যেই চরটা হইয়া উঠিল ঘন সবুজ।
চাষীর দল হাল-গরু লইয়া মাঠে গিয়া পড়িল। ধানচাষের সময় একেবারে মাথার উপর আসিয়া পড়িয়াছে। কাজেই নবীন ও রংলাল ধানের জমি লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িল, চরটার দিকে আর মনযোগ দিতে পারিল না। ধানের বীজ বুনিবার জন্য হাফরের জমিতে আগে হইতেই চাষ দেওয়া ছিল, এখন আবার তাহাতে দুই বার লাঙল দিয়া তাহার উপর মই চালাইয়া জমিগুলির মাটি ভুরার মত গুঁড়া করিয়া বীজ বুনিয়া দিল। অন্য জমি হইতে বীজের জমিগুলোকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করিয়া রাখিবার জন্য একখানা করিয়া তালপাতা কাটিয়া তাহাতে পুঁতিয়া রাখিল। ওই চিহ্ন দেখিয়াই রাখালেরা সাবধান হইবে, এই জমিগুলিতে গরুবাছুর নামিতে দিবে না।
আষাঢ়ের মাঝামাঝি আবার এক পসলা জোর বৃষ্টি নামিল; ফলে মাটি অতিরিক্ত নরম হওয়ায় চাষ বন্ধ হইয়া গেল। নবীন আসিয়া বলিল, মোড়ল, এইবারে চরের ওপর একবার জোটপাট করে চল। এখন একবার চষে-খুঁড়ে না রাখতে পারলে আশ্বিন-কার্তিক মাসে কি আর ওখানে ঢোকা যাবে? একেই তো বেনার মুড়োতে আদাড় হয়ে আছে।
রংলাল বসিয়া তামাক খাইতেছিল, সে বলিল, এই বসে বসে আমিও ওই কথাই ভাবছিলাম লোহার। ওখানে তো একা একা কাজ সুবিধে হবে না, উ তোমার ‘গাতো’ করে কাজ করতে হবে। একেবারে পাঁচজনার হাল-আমার দুখানা, তোমার দুখানা, আর উ তিনজনার তিনখানা-এই সাতখানা হাল নিয়ে একেবারে গিয়ে পড়তে হবে! ওদের জমিতে একদিন করে, আর আমাদের দুখানা করে হাল আমরা দুদিন করে লোব। -বলিয়া সে হুঁকা হইতে কল্কে খসাইয়া নবীনকে দিয়া বলিল, লও, খাও!
কল্কেতে টান মারিয়াই নবীন কাশিয়া সারা হইয়া গেল, কাশিতে কাশিতে বলিল, বাবা রে, এ যে বিষ! বেজায় চড়া হয়ে গিয়েছে হে।
হাসিয়া রংলাল বলিল, হুঁ হুঁ, বর্ষার জন্যে তৈরী করে রাখলাম। জলে ভিজে হালুনি যখন লাগবে, তখন তোমার একটান টানলেই গরম হয়ে যাবে শরীর।
তা বটে। এখন কিন্তু এ তোমার বিষ হয়ে উঠেছে।–বলিয়া সে কল্কেটি আবার রংলালকে ফিরাইয়া দিল।
রংলাল বলিল, তা হলে কালই চল সব জোটপাট করে। মাঠানে তো এখন তোমার চার-পাঁচ দিন হাল লাগবে না।
তাতেই তো এলাম গো তোমার কাছে। বলি, মোড়লের ঘুম ভাঙিয়ে আসি একবার। এই নরম মাটিতে বেনা কাশ বেবাক উঠে যাবে তোমার। কিন্তু একটা কথা ভাবছি হে,- ভাবছি, চক্কত্তি-বাড়ি থেকে যদি হাঙ্গামাহুজ্জৎ করে তো কি হবে? জমি তো বন্দোবস্ত করে দেয় নাই।
ক্ষেপেছ তুমি! হাঙ্গামা করবে কে হে বাপু? কত্তা তো ক্ষেপে গিয়েছে। আবার নাকি শুনছি, বড় রোগ হয়েছে হাতে। বড় ছেলে তো কালাপানি, ছোটজনা তো পড়তে গিয়েছে কদিন হল। মজুমদারের জবাব হয়ে গিয়েছে। আর মজুমদারই তো তোমার হাঁ করে আছে, আবার একবার বাগে পেলে হয়। থাকবার মধ্যে গিন্নীমা আর মানদা ঝি। হুকুম দেবে গিন্নীমা আর লড়বে তোমার মানদা ঝি, না কি? -বলিয়া রংলাল হি-হি করিয়া হাসিয়া সারা হইল!
নবীন আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, উহুঁ। ছোটজনা ভারি হুঁশিয়ার ছেলে হে, সে ভারী এক চাল চেলে গিয়েছে। সেই যি পঞ্চাশ বিঘে জমি, আমাদিগেও দিলে না, সাঁওতালদিগেও দিলে না, সেই জমিটা ভাগে বন্দোবস্ত করে দিয়েছে যত ছোকরা মাঝিদিগে! এখন যা হয়েছে, তাতে গিন্নী ঠাকরুন হুকুম দিলে গোটা সাঁওতাল-পাড়া হয়তো ভেঙে আসবে।
এবার রংলাল বেশ একটু চিন্তিত হইয়া পড়িল, নীরবে বসিয়া মাথার চুলের মধ্যে আঙুল চালাইয়া মুঠায় ধরিয়া চুল টানিতে আরম্ভ করিল। নবীন আপনার পায়ের বুড়ো-আঙুলের নখ টিপিতেছিল; কিছুক্ষণ পর সে ডাকিল, মোড়ল!
উ!
তা হলে?
সেই ভাবছি।
আমি বলছিলাম কি, গিন্নীঠাক্রুনের কাছে গিয়ে বন্দোবস্তের হাঙ্গামা মিটিয়ে ফেলাই ভাল; কাজ কি বাপু লোকের ন্যায্য পাওনা ফাঁকি দিয়ে? তার ওপর ধর, জমিদার-ব্রাহ্মণ।
উঁহু, সে হবে না। যখন বলেছি, সেলামী দেব না, তখন দেব না!
তা হলে?
তা হলে আর কি হবে; হাল-গরু নিয়ে চল তো কাল, তারপর যা হয় হবে।
উঠিয়ে দিলে তো মান থাকবে না, সে কথাটা ভাব।
রংলাল খানিকটা মুচকি হাসিল, তারপর বলিল, তখন মেজেস্টারিতে দরখাস্ত দেব যে, আমাদের জমি থেকে জোর করে জমিদার তুলে দিয়েছে।
নবীন চক্রবর্তী-বাড়ির অনেক দিনের চাকর, উপস্থিত চাকরি না থাকিলেও এই পুরাতন মনিব-বাড়ির জন্য সে খানিকটা মমতা অনুভব করে। সেই প্রভুবংশের সহিত এই ধারায় বিরোধ করিতে তাহার মন সায় দিল না। সে মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল।
রংলাল বলিল, কি হল, চুপ করে রইলে যে? চলই তো জোট-পাট করে, দেখাই যাক না, কি হয়?
নবীন এবার বলিল, সে ভাই আমি পারব না। লোকে কি বলবে একবার ভাব দেখি।
রংলাল হাসিল, তারপর দুই হাতের বুড়ো আঙুল দুইটি একত্র করিয়া নবীনের মুখের কাছে ধরিয়া বলিল, কচু। লোকে বলবে কচু। তুমি ঘরে তুলবে আলু গম কলাই গুড়, আর লোকে বলবে কচু।
নবীন তবুও চুপ করিয়া রহিল। রংলাল এবার তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল, চল, একবার ঘুরে ফিরে ভাবগতিকটা বুঝে আসি। সাঁওতাল বেটাদের কি রকম হুকুম-টুকুম দেওয়া আছে, গেলেই জানা যাবে। আর ধর গা জমিটার অবস্থাও দেখা হবে। চল, চল।
নবীন ইহাতে আপত্তি করিল না, উঠিল।
কালি নদীতে ইহারই মধ্যে জল খানিকটা বাড়িয়েছে, এখন হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়া যায়। কয়েকদিন আগে জল অনেকটা বাড়িয়া উঠিয়াছিল, উপরের বালুচর পর্যন্ত ছিলছিলে রাঙা জলে ডুবিয়া গিয়াছিল। জল এখন নামিয়া গিয়াছে। বালির উপরে পাতলা এক স্তর লাল মাটি জমিয়া আছে। রৌদ্রের উত্তাপে এখন সে স্তরটি ফাটিয়া টুকরা টুকরা হয়ে গিয়াছে, পা দিলেই মুড়মুড় করিয়া ভাঙিয়া বালির সহিত মিশিয়া যায়। তবুও এই লক্ষ টুকরায় বিভক্ত পাতলা মাটির স্তরের উপর এখনও কত বিচিত্র ছবি জাগিয়া আছে। -কাঁচা মাটির উপর পাখীরা পায়ের দাগ রাখিয়া গিয়াছে, আঁকাবাঁকা সারিতে নকশা-আঁকা কাপড়ের চেয়েও বিচিত্র ছক সাজাইয়া তুলিয়াছে যেন। তাহারই মধ্যে প্রচণ্ড চওড়া মানুষের দুইটি পায়ের ছাপ চলিয়া গিয়েছে, এ বোধ করি ওই কমল মাঝির পায়ের দাগ! একটা প্রকাণ্ড সাপ চলিয়া যাওয়ার মসৃন বঙ্কিম রেখা একেবারে চরের কোল পর্যন্ত বিস্তৃত আছে। ভিতরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখিলে দেখা যায়, অতি সুক্ষ্ম বিচিত্র রেখায় লক্ষ লক্ষ পতঙ্গের পাদচিহ্ন।
বেনা ও কাশের গুল্মে ইহারই মধ্যে সতেজ সবুজ পাতা বাহির হইয়া বেশ জমাট বাঁধিয়া উঠিয়াছে, বন্য লতাগুলিতে নূতন ডগা দেখা দিয়াছে, ভিতরে ভিতরে শিকড় হইতে কত নূতন গাছ গজাইয়া উঠিয়াছে, সাঁওতালদের পরিস্কার করা পথের উপরেও ঘাস জন্মিয়াছে, কুশের অঙ্কুরে কন্টকিত হইয়া উঠিয়াছে।
তীক্ষ্ণাগ্র কুশের উপর চলিতে চলিতে বিব্রত হইয়া রংলাল বলিল, ঐ বেটারাও বাবু হয়ে গিয়েছে নবীন, রাস্তাটা কি করে রেখেছে দেখ দেখি।
নবীন বলিল, ওদের পা আমাদের চেয়ে শক্ত হে।
পল্লীর প্রান্তে সাঁওতালদের জমির কাছে আসিয়া তাহারা কিন্তু অবাক হইয়া গেল। ইহার মধ্যে প্রায় সমস্ত জমি সবুজ ফসলে ভরিয়া উঠিয়াছে। চষিয়া খুঁড়িয়া নিড়ান দিয়া তাহারা ভুট্টা, শন, অড়হর বুনিয়া শেষ করিয়া ফেলিয়াছে; জমির ধারে সারিবন্দী চারা, তাহাতে শিম, বরবটি, খেঁড়ো, কাঁকুড়ের অঙ্কুর বাহির হইয়া পড়িয়াছে। ধানের জমিগুলি চাষ দিয়া সার ছড়াইয়া একেবারে প্রস্তুত করিয়া ফেলিয়াছে। বাড়িঘরের চালে নূতন খড় চাপানো হইয়া গিয়াছে, কাঁচা সোনার রঙের নূতন খড়ের বিছানি অপরাহ্নের রৌদ্রে ঝকঝক করিতেছে। ইহাদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ সত্ত্বেও রংলাল এবং নবীন মুগ্ধ হইয়া গেল। রংলাল বলিল, বা বা বা! বেটারা এরই মধ্যে করে ফেলেছে কি হে, অ্যাঁ! ঘাস-টাস ঘুচিয়ে বিশ বছরের চষা জমির মত সব তকতক করছে!
নবীন হেঁট হইয়া ফসলের অঙ্কুরগুলিকে পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছিল। সে বলিল, অড়লের কেমন জাত দেখ দেখি। একটা বীজও বাদ যায় নাই হে! তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আর আমাদের জমিতে হয়তো ঢুকতেই পারা যাবে না। দেখলে তো, বেনা আর কাশ কি রকম বেড়ে উঠেছে।
আরও খানিকটা অগ্রসর হইয়া অহীন্দ্র যে জমিটা খাসে রাখিয়াছে, সেই অংশটার ভিতর তাহারা আসিয়া পড়িল। তখনও সেখানে কয়জন জোয়ান সাঁওতাল মাটি কোপাইয়া বেনা ও কাশের শিকড় তুলিয়া ফেলিতেছিল। এ অংশটার অনেকটা তাহারা সাফ করিয়া ফেলিয়াছে, তবুও নতুন বলিয়া এখানে ওখানে দুই-চারিটা পরিত্যক্ত শিকড় হইতে ঘাস গজাইয়া উঠিতেছে, এখনও জমির আকারও ধরিয়া উঠে নাই, এখানে ওখানে উঁচু নীচু অসমতল ভাবও সমান হয় নাই। তবুও উহারই মধ্যে যে অংশটা অপেক্ষাকৃত পরিস্কার হইয়াছে, তাহারই উপর ভুট্টা বুনিয়া ফেলিয়াছে। সে-জমিটা অতিক্রম করিয়া আপনাদের জমির কাছে আসিয়া তাহারা থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল। সত্যই বেনা ঘাসে কাশের গুল্মে নানা আগাছায় সে যেন দুর্ভেদ্য হইয়া উঠিয়াছে। বেনা ও কাশ ইহারই মধ্যে এমন বাড়িয়া গিয়াছে যে, মানুষের বুক পর্যন্ত ডুবিয়া যায়। এই জঙ্গলের মধ্যে লাঙল চষিবে কেমন করিয়া?
নবীন বলিল, ঘাস কেটে না ফেললে আর উপায় নেই মোড়ল!
রংলাল চিন্তিত মুখেই বলিল, তাই দেখছি।
নবীন বলিল এক কাজ করলে হয় না মোড়ল? সাঁওতালদিগেই এ বছরের মত ভাগে দিলে হয় না? এবার ওরা কেটে কুটে সাফ করুক, চষে খুঁড়ে ঠিক করুক, তারপর আসছে বছর থেকে আমরা নিজেরা লাগব।
যুক্তিটা রংলালের মন্দ লাগিল না। সে বলিল, তাই চল, দেখি বেটাদের বলে।
সেই পরামর্শ করিয়া তাহারা আসিয়া সাঁওতালদের পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিল, ঝক্ঝকে তকতকে পল্লী, পথে বা ঘরের আঙিনায় কোথাও এতটুকু আবর্জনা নাই। পল্লীর আশেপাশে তখনও গরু মহিষ ছাগল চরিয়া বেড়াইতেছে। সারের গাদার উপর মুরগীর দল খুঁটিয়া খুঁটিয়া আহার সংগ্রহে ব্যস্ত। আঙিনার পাশে পাশে মাচার উপর কাঠশিম, লাউ, কুমড়ার লতা বাসুকির মত সহস্র ফণা বিস্তার করিয়া বাড়িয়া চলিয়াছে যেন। বাড়িগুলির বাহিরে চারিদিক ঘিরিয়া সরলরেখার মত সোজা লম্বা বাঁধ তৈয়ারী করিয়াছে, তাহারই উপর সারবন্দী জাফরি বসানো। ভিতরে আম কাঁঠাল মহুয়ার গাছ পুঁতিয়া ফেলিয়াছে, মধ্যে মধ্যে সজিনার ডাল এবং মূল সমেত বাঁশের কলম লাগাইয়া চারিপাশে কাঁটা দিয়া ঘিরিয়া দিয়াছে।
রংলাল বলিল, বাকি আর কিছু রাখে নাই বেটারা, ফল ফুল শজ্নে বাঁশ-একেবারে ইন্দ্র ভুবন করে ফেলেছে হে! জাত বটে বাবা!
প্রথমেই পুতুলনাচের ওস্তাদ চূড়া মাঝির ঘর; মাঝি ছুতারের যন্ত্রপাতি লইয়া উঠানে বসিয়া লাঙল তৈয়ারি করিতেছিল। একটি অল্পবয়সী ছেলে তাহার সাহায্য করিতেছে। একখানা প্রায়-সমাপ্ত লাঙলের উপর হাল্কাভাবে যন্ত্র চালাইতে চালাইতে মাঝি গুনগুন করিয়া গান করিতেছিল। নবীন লাঙলখানার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল, দেখেছ কেমন পাতলা আর কতটা লম্বা?
রংলাল দেখিয়া মুখ বাঁকাইয়া বলিল, বাজে! এত সরুতে পাশের মাটি ধরবে কেন? ওর চেয়ে আমাদের ভাল। যাক্গে। এখন তো আমাদের কাজের কথা। এই মাঝি, মোড়ল কোথা রে তোদের?
ওস্তাদ কথার কোন উত্তর দিল না, আপন মনেই কাজ করিতে লাগিল। রংলাল বিরক্ত হইয়া বলিল, এ-ই শুনছিস?
মুখ না তুলিয়াই এবার চূড়া বলিল, কি?
তোদের মোড়ল কোথা?
মোড়ল?
হ্যাঁ।
মোড়ল?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
চূড়া এবার হাতের যন্ত্রটা রাখিয়া দিয়া কোন কিছুর জন্য আপনার ট্যাঁক হইতে কাপড়ের খুঁট পর্যন্ত খুঁজিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু সে বস্তুটা না পাইয়া অত্যন্ত হতাশভাবে বলিল, পেলাম না গো।
রংলাল সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, ওই! বেটা বলছে কি হে!
চূড়া সকরুণ মুখে বলিল, রেখেছিলাম তো বেঁধে। পড়ে গেঁইছে কোথা।
রংলাল অত্যন্ত চটিয়া উঠিয়া বলিল, দেখ দেখি বেটার আস্পর্ধা, ঠাট্টা-মস্করা আরম্ভ করেছে!
চূড়া এবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল, মানুষ আপনার ঘরকে থাকে। তুরা তার ঘরকে যা। আমাকে শুধালি কেনে?
রংলাল কোন কথা বলিল না, নবীনের হাত ধরিয়া টানিয়া ক্রদ্ধ পদক্ষেপেই অগ্রসর হইল। চূড়া পেছন হইতে অতি মিষ্ট স্বরে ডাকিল, মোড়ল! ও মোড়ল!
রংলাল বুঝিল, লোকটা অনুতপ্ত হইয়াছে, সে ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল, কি?
চূড়া কোন কথা বলিল না, তাহার সমস্ত শরীরের কোন একটি পেশি নড়িল না, শুধু বড় বড় কাঁচা-পাকা গোঁফ জোড়াটি অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচিয়া উঠিল। গোঁফের সে নৃত্যভঙ্গিমা যেমন হাস্যকর, তেমনই অদ্ভুত। তাহা দেখিয়া রংলালও হাসিয়া ফেলিল, বেটা আমার রসিক রে!
চূড়া এবার বলিল, বুলছি, রাগ করিস না গো।
মোড়ল মাঝির উঠানে খাটিয়ার উপর একটি আধা-ভদ্রলোক বসিয়া ছিল। কমল মাটির উপর উবু হইয়া বসিয়া কথা বলিতেছিল। লোকটির গায়ে একখানি চাদর, পায়ে একজোড়া চটিজুতো, হাতে মোটা বাঁশের ছড়ি, চোখে পুরু একজোড়া চশমা-সূতা দিয়া মাথা বেড়িয়া বাঁধা। চশমাশুদ্ধ চোখ একরূপ আকাশে তুলিয়া রংলাল ও নবীনকে দেখিয়া লোকটা বলিল, ওই, পাল মশায় যে? লোহারও সঙ্গে? কি মনে করে গো?
রংলাল ঈষৎ হাসিয়া বলিল, বলি, আপুনি কি মনে করে গো?
লোকটি বলিল, আর বল কেন ভাই, এরা ধরেছে বর্ষার সময় ধান দিতে হবে। তাই একবার দেখতে শুনতে এলাম। তা এরা করেছে বেশ, এরই মধ্যে গেরামখানিকে বে-শ করে ফেলেছে হে! তারপর, শুনলাম, আপনারাও জমি নিয়েছেন? তা আমাদিগে বললে কি আর আপনাদের জমি আমরা কেড়ে নিতাম? আমরাও খানিক আধেক নিতাম আর কি!
নবীন বলিল, বেশ, পাল মশায় বলেন ভাল! আমদিগেই কি আর দেয় জমি! কোন রকম করে হাতে পায়ে ধরে তবে আমরা পেলাম। তার উপর কে চন্দ রাজা, কে চন্দ মন্ত্রী-কোন হদিস নাই।
লোকটি হাসিয়া বলিল, তা দেখছি। চার কোণে চার কোপ দিয়ে গেলেই হল। বাস্, জমি দখল হয়ে গেল। কই, এখনও তো কিছু করতে পারে নাই দেখলাম। এবার আর ওতে হাত দিতেও পারবেন না। এদিকে আবার ধানচাষ এসে পড়ল হু-হু করে।
রংলাল বলিল, এবার ভাবছি সাঁওতালদিগেই ভাগে দিয়ে দেব, ওরাই চাষ-খোঁড় করুক, যা পারে লাগাক, যা খুশি হয় আমাদের দেবে, তাই এলাম একবার মোড়লের কাছে। শুনছিস মোড়ল?
কমল মাঝি দুই হাতে মাথা ধরিয়া বসিয়া ছিল, সে বলিল, তা তো শুনলাম গো।
তা কি বলছিস?
উঁ-হুঁ, সে আমরা লারব। তুরা তো আবার কেড়ে লিবি। আমরা তবে কেনে তুদের জমি ঠিক করে দিব? আমাদিগে পয়সা দিয়ে খাটায়ে লে কেনে।
কেন, গরজ বুঝছিস নাকি?
তুরাই তো দেখাইছিস গো সিটি। আমরা খাটব, জমি করব, আর তুরা তখন জমিটা কেড়ে লিবি।
নূতন লোকটা এবার বলিল, আমি উঠছি মাঝি। তা হলে ওই কথাই ঠিক রইল।
মাঝি বলিল, হুঁ, সেই হল। আপুনি আসবি তো ঠিক?
ঠিক আসব আমি। তারপর রংলাল ও নবীনকে বলিল, বেশ, তা হলে কথাবার্তা বলুন আপনারা, আমি চললাম।
লোকটি চলিয়া গেলে রংলাল বলিল, হ্যাঁ মাঝি, তোরা ওর কাছে ধান লিবি? তোদের গলা কেটে ফেলবে। খবরদার খবরদার। এক মণ ধানে শ্রীবাস আধ মন সুদ লেয়, খবরদার।
মাঝি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, উঁহু উ সুদ লিব না বুললে। উ আমাদের পাড়াতে দুকান করছে। একটি খামার করছে। আমদিগে জমি দিলে ভাগে। আমরা উয়ার জমি কেটে চষে ঠিক করে দেব।
রংলাল বিস্মিত হইয়া বলিল, পাল এখানে জমি নিয়েছে নাকি?
হুঁ গো। ওই তো, তুদের জমিটাই উ লিলে। বাবুদিগে টাকা দিলে, দলিল করে লিলে, চেক লিলে। কাল সব পাড়াসুদ্ধ ওই জমিতে লাগব। উনি আসবেন লোকজন লিয়ে।
রংলাল নবীন উভয়েই বিস্ময়ের আঘাতে স্তম্ভিত হইয়া মাটির পুতুলের মত দাঁড়াইয়া রহিল।
কমল পাড়ার এক প্রান্তে প্রকাণ্ড একটা খড়ের চাল দেখাইয়া বলিল, উই দেখ কেনে-উ দুকান করেছে উইখানে। উয়ার কাছে যা কেনে তুরে।
রংলাল নবীন উভয়েই হতাশায় ক্রোধে অস্থির চিত্তে দোকানের দিকে অগ্রসর হইল। লোকটি সোজা লোক নয়। এখানে সদগোপ্দের মধ্যে শ্রীবাস পাল বর্ধিষ্ণু লোক। বিস্তৃত চাষ তো আছেই, তাহার উপর নগদ টাকা এবং ধানের মহাজনিও করিয়া থাকে। বড় ছেলে একটা মনিহারীর দোকান খুলিয়াছে।
সাঁওতাল-পল্লীর এক প্রান্তে বেশ বড় একখানি চালা তুলিয়া তাহার চারিপাশে ঘিরিয়া ছিটা-বেড়ার দেওয়াল দিয়া কয় দিনের মধ্যেই শ্রীবাস দোকান খুলিয়া ফেলিয়াছে। এক পাশে নটকোনার দোকান, মধ্যে একটা তক্তপোশের উপর দস্তার গহনা, কার, পুঁতির মালা, রঙিন নকল রেশমের গুছি, কাঠের চিরুনি, আয়না-এই সব লইয়া কিছু মনিহারী সাজানো রহিয়াছে, এ দিকের এক কোণে তেলে-ভাজা খাবার বিক্রয় হইতেছে। পল্লীর মেয়েরা ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া জিনিস কিনিতেছিল।
রংলাল আসিয়া ডাকিল, পাল মশায়।
পালের ছোট ছেলে মুখ তুলিয়া তাহাদিগকে দেখিয়া বলিল, বাবা তো বাড়ি চলে গিয়েছেন।
রংলাল সঙ্গে সঙ্গে ফিরিল, পথ বাছিল না, জঙ্গল ভাঙিয়াই গ্রামের মুখে ফিরিল। পালের ছেলে বলিল, এই রাস্তায় রাস্তায় যান গো, বরাবর নদীর ঘাট পর্যন্ত রাস্তা পড়ে গিয়েছে।
সত্যই সবুজ ঘাসের উপর একটি গাড়ির চাকার দাগ-চিহ্নিত পথের রেশ বেশ পরিস্কার ফুটিয়া উঠিয়াছে ইহারই মধ্যে, কিছু জঙ্গল কাটিয়াও ফেলা হইয়েছে। পথ বাছিয়া চলিবার মত মনের অবস্থা তখন রংলালের নয়, সে জঙ্গল ভাঙিয়াই গ্রামের দিকে অগ্রসর হইল।