ইন্দ্র রায় সত্যই বলেছিলেন, চরটা কীট-পতঙ্গ-সরীসৃপে পরিপূর্ণ।
গ্রামের কোলেই কালিন্দী নদীর অগভীর জলস্রোত পার হইয়া খানিকটা বালি ও পলিমাটিতে মিশানো তৃণহীন স্থান, তার পরেই আরম্ভ হইয়াছে চর। সমগ্র চরটা বেনাঘাস আর কাশের ঘন জঙ্গলে একেবারে আচ্ছন্ন হইয়া আছে। তাহারই মধ্যে বাসা বাঁধিয়া আছে-অসংখ্য প্রকারের কীট-পতঙ্গ আর সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মত ভয়ঙ্কর নানা ধরনের বিষধর সাপ
প্রৌঢ় রংলাল মণ্ডল বলিল, এই তো ক বছর হল গো বাবু মশায়, একটা বাছুর কি রকম ছটকিয়ে গিয়ে পড়েছিল চরের উপর। বাস্, আর যায় কোথা, ইয়া এক পাহাড়ে চিতি-ধরলে পিছনের ঠ্যাঙে। আঃ, সে কি বাছুরটার চেঁচানি! বাস্, বার কতক চেঁচানির পরই ধরলে পাক দিয়ে জড়িয়ে। দেখতে দেখতে বাছুরটা হয়ে গেল ময়দার নেচির মত লম্বা। কিন্তু কারু সাহস হল না যে এগিয়ে যাই।
অহীন্দ্র প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, আগে নাকি ওই চরের ওপরেই ছিল কালী নদী?
হ্যাঁ গো। ঠিক ওই চরের মাঝখানে। লদীর ঘাট থেকে গেরাম ছিল একপো রাস্তার ওপর। বোশেখ মাসে দুপুরবেলায় লদীর ঘাটে আসতে পায়ে ফোস্কা পড়ে যেত।
তুমি দেখেছ?
অহীন্দ্রের ছেলেমানুষিতে কৌতুক অনুভব করিয়াই যেন রংলাল বলিল, আই দেখেন, দাদাবাবু আবার বলেন কি দেখ। কালী নদীর ধারেই-ওই দেখেন, চরের পরই যেখানে চোরাবালি-ওইখানে আমাদের পঁচিশ কাঠা আওয়াল জমি ছিল, তারপর ওই চর যেখানে আরম্ভ হয়েছে-ওইখানে ছিল গো-চর নদীর ওলা। ছেলেবেলায় আমি ওইখানেই গরু চরিয়েছি! ওই জমিতে আমি নিজে লাঙল চষেছি। তখন আমাদের গরু ছিল কি মশায়-এই হাতির মত বলদ। আর রতন কামারের গড়া ফাল-একহাত মাটি একেবারে দু ফাঁক হয়ে যেত! আঃ! মাটিরই বা কি রঙ-একেবারে লাল-সেরাক!
বৃদ্ধ চাষী মনের আবেগে পুরাতন স্মৃতিকথা বলিয়া যায়, অহীন্দ্র কালী নদীর তটভূমিতে চরের প্রান্তভাগে বসিয়া চরের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া শুনিয়া যায়। বৃদ্ধ বলে, কালী নদীর একেবারে তটভূমিতে সে কি নধর কচি ঘাস গালিচার মত পুরু হইয়া থাকিত, সারা গ্রামের গরু খাইয়া শেষ করিতে পারিত না। তাহার পর ছিল তরির জমি। সে আমলে তুঁতপাতার চাষ ছিল একটা প্রধান চাষ। জবগাছের পাতার মত তুঁতের পাতা। চাষীরা বাড়িতে গুটিপোকা পালন করিত,–গুটিপোকার খাদ্য এই তুঁতপাতা। যে চাষী গুটিপোকা পালন করিত না, তুঁতগাছের চাষ করিত, তুঁতপাতা বিক্রয় করিয়াও সেও দশ টাকা রোজগার করিত। তখন গ্রামেরই বা শোভা কি! বাবুরাই বা কি সব, এক-একজন দিকপাল যেন। ছাতি কি বুকের! রংলাল বলিল, আপনকার কত্তাবাবা, বাপ রে, বাপ রে, ‘রংলাল’ বলে হেঁকেছেন তো জান একেবারে খাঁচাছাড়া হয়ে যেত।
অহীন্দ্র চরের উপর দৃষ্টি রাখিয়াই প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, কোন্ বছর কালী প্রথম এ-কূল ভাঙল, তোমার মনে আছে!
পিতামহ-প্রপিতামহের ইতিহাস সে বহুবার শুনিয়াছে, আর ওই চরটাই তাহার মন অধিকার করিয়া আছে। নদীর বুকে নাকি ব- দ্বীপগুলি এবং নদী-সাগর-সঙ্গমের মুখে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপগুলি হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া পলি জমিয়া জমিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে, উঠিতেছে এবং উঠিবে। বাংলার নিম্নাংশটা গোটাই নাকি এমনই করিয়া জলতল হইতে উঠিয়াছে। কত প্রবালকীট, কত শুক্তি-শামুকের দেহ পলির স্তরে স্তরে চাপা পড়িয়া আছে! ভূগোলের মাস্টার কৃষ্ণবাবু কি চমৎকারই না কথাগুলি বলেন!
রংলাল বলিল, কালী তো আমাদের সামান্য নদী লয় দাদাবাবু, উনি হলেন সাক্ষাৎ যমের ভগ্নী। কবে থেকে যে উনি রায়হাটের কূল তলে তলে খেতে আরম্ভ করেছেন, তা কে বলবে বলেন! তবে উনি যে কালে হাত বাড়িয়েছেন, তখন আপনার রায়হাট উনি আর রাখবেন না। বললাম যে, যমের ভগ্নী উনি। বুঝলেন কালী যাকে নিলে, কার সাধ্যি তাকে বাঁচায়! কত গেরাম যে উনি খেয়েছেন, তার আর ঠিক-ঠিকেনা নাই। ফি বছর দেখবে, কত চাল, কত কাঠ, কত গরু, কত মানুষ কালীর বানে ভেসে চলেছে যমের বাড়ি। একবার সাক্ষাৎ পেত্যক্ষ করেছি আমি। তখন আমার জোয়ান বয়েস; দেখলাম, একখানা ঘরের চালের ওপর বসে ভেসে যাচ্ছে একটি মেয়ে, কোলে তার কচি ছেলে। উঃ, কি তার কান্না, সে কান্নায় গাছপাথর কাঁদে দাদাবাবু! আমি মশাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমাদের সরু লৌকো নিয়ে, সঙ্গে নিলাম কাছি। একে স্রোতের মুখে, তার ওপর কষে ঠেল মারলাম দাঁড়ের। সোঁ সোঁ করে গিয়ে পড়লাম চালের কাছে। আঃ, তখন মেয়েটির কি মুখের হাসি! সে বুঝল আমি বাঁচলাম। মশায়, বলব কি, ঠিক সেই সময়েই উঠল একটা ঘুরনচাকি, আর বাস্, বোঁ ক’রে ঘুরপাক মেরে নিলে একেবারে চালসুদ্ধ পেটের ভেতর ভরে। কলকল করে জল যেন ডেকে উঠল, বলব কি দাদাবাবু, ঠিক যেন খলখল করে হেসে উঠলে কালী। সে হাতজোড় করিয়া কপালে ঠেকাইয়া উদ্দেশে কালীকে প্রণাম করিল। সে বলিল, অ্যাই, সেই বছরেই দেখলাম, কালী-মা এই কূল দিয়ে চলেছেন।
সেই বৎসরেই শীতকালে দেখা গেল, কালীর অগভীর জলস্রোত ওপারের দিকে বালি ঠেলিয়া দিয়া রায়হাটের কোল ঘেঁষিয়া আসিয়া প্রবাহিত হইতেছে। তার পর বৎসরের পর বৎসর ও-পাশে জমিতে আরম্ভ করিল বালি পড়িতে আর এদিক হইল গভীর। বর্ষার যখন কালী হইত দুকূলপ্লাবী, তখন কিন্তু এপার হইতে ওপার পর্যন্ত জল ছাড়া কিছুই দেখা যাইত না। তখন ওপারটা ছিল ছয় মাস জল আর ছয় মাস বালির স্তূপ। তার পর প্রথমেই গ্রাস করিল এপারের গো-চারণের জন্য নির্দিষ্ট তৃণশ্যামল তটভূমিটুকু। ওপারে তখন হইতে বর্ষার শেষে বালির উপর পাতলা পলির স্তর জমিতে আরম্ভ করিল।
রংলাল বলিল, বুঝলেন দাদাবাবু, শুধু কি পলি; রাজ্যের জিনিস-এই আপনার খড়কুটো ঘাসপাতা যা খেতেন কালী, এসে উগড়ে দিতেন এই চরের ওপর। আর তার ওপর দিতেন মাটি আর বালি চাপা।
বলিতে বলিতে বৃদ্ধ চাষীর মনে যেন দার্শনিকতার উচ্ছ্বাস জাগিয়া উঠিল, সে বলিল, এই আমাদের মেয়েগুলো খেলে দেখেন না, ভিজে বালির ভেতর পা পুরে তার ওপর বালি চাপিয়ে চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে পা-টি বের করে নেয়, কেমন ঘর হয়! আবার মনে হয় লাথি মেরে–ভাঙে আর বলে, হাতের সুখে গড়লাম, আর পায়ের সুখে ভাঙলাম। কালীও আমাদের তাই–ভাঙতে যেমন, আর গড়তেও তেমন। উঃ, কত কী যে এসে জমা হত দাদাবাবু, শামুক-গুগলি-ঝিনুক সে সব কত রকমের, বাহার কি সব! খরার সময় সব সেঁতানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত, তখন ছেলেমেয়েরা চরের ধারে ধারে সে-সব ঝিনুক কুড়োতে যেত। ছোট ছোট ঝিনুকে ঘামাচি মারত সব পুটপাট করে। কেউ কেউ লক্ষ্মীবেদীতে বসিয়ে বসিয়ে আলপনার মত লতাপাতা তৈরি করত। তখন আপনার জলথল পড়লে খুদি খুদি ঘাস হত এই আপনার গরুর রোঁয়ার মত।
কালী ঠিক যেন বালিকার মত খেলাঘর পাতিয়াছিল ওইখানে। বালিকার মত যেখানে যাহা পাইত, আনিয়া ওইখানে জড় করিয়া রাখিত। আর তার উপর চাপা দিত বালি আর পলি।
অহীন্দ্র আবার প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, তোমরা সব তখন এই চর কার তা মীমাংসা করে নাও নি কেন?
রংলাল অহীন্দ্রের নির্বুদ্ধিতায় হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিল, অ্যাই দেখেন, দাদাবাবু কি বলেন দেখেন। তখন উ চর নিয়ে লোকে করবে কি? এই এখানে খানিক খাল, চোরাবালি, ওখানে বালির ঢিপি; আর যে পোকার ধুম। ছোটলোকের মেয়েরা পর্যন্ত কাঠকুটো কুড়োতে চরের ভেতর যেত না। বুঝলেন, খুদি খুদি পোকায় একেবারে অষ্টাঙ্গ ছেঁকে ধরত। তার আবার জ্বালা কি, ফুলে উঠত শরীর।
চৈত্র মাসের অপরাহ্ন; সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভ হইয়া অস্তাচলের সমীপবর্তী হইতে চলিয়াছে। কালীর ওপারে রায়হাটে তটভূমিতে বড় বড় গাছ। শিমূলগাছই বেশী, শিমূলের নিঃশেষে পত্রহীন শাখা-প্রশাখার সর্বাঙ্গ ভরিয়া রক্ত-রাঙা ফুলের সমারোহ। পালদে গাছগুলিও তাই, পত্ররিক্ত এবং শিমূলের চেয়েও গাঢ় রক্তবর্ণের পুষ্পসম্ভারে সমৃদ্ধ। বসন্তের বাতাসে কোথা হইতে একটি অতি মধুর গন্ধ আসিয়া শ্বাসযন্ত্র ভরিয়া দিল।
অহীন্দ্র বার বার গন্ধটি গ্রহণ করিয়া বলিল, কি ফুলের গন্ধ বল তো?
নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সহিত রংলাল বলিল, উ ওই চরের মধ্যে কোন ফুল-টুল ফুটে থাকবে। ওর কি কেউ নাম জানে। কোথা থেকে কি এনে কালী যে লাগান ওখানে, ও এক ওই কালীই জানেন। বুঝলেন, এই প্রথম বার যে বার-ঘাস বেশ ভাল রকমের হল, আমরা গরু চরাব বলে দেখতে এসেছিলেম।
বলিতে বলিতে রংলালের মুখে সেই দিনের সেই বিস্ময় ফুটিয়া উঠে, সে বলিয়া যায়, কত রকমের নাম-না-জানা চোখে-না-দেখা ছোট ছোট লতা-গাছ-ঘাস ওই চরের উপর তখন যে জন্মিয়াছিল, তাহার আর ইয়াত্তা নাই। আর ঘাসে পা দিলেই লাফাইয়া উঠিত ফড়িং-জাতীয় শত শত কীট, উপড়ে উড়িয়া বেড়াইত হাজারো রকমের প্রজাপতি ফড়িং। তার পর জন্মিয়াছে ওই বেনাঘাস আর কাশগুল্ম। কিন্তু উহার ভিতরে ভিতরে কত যে গাছ, কত যে লতা আত্মগোপন করিয়া আছে, তাহার সংখ্যা কি কেহ জানে ? আর ওই সব মধুগন্ধী গাছের গোড়ায় বাসা বাঁধিয়াছে কত বিষধর -! বলিতে বলিতে রংলাল শিহরিয়া উঠিল, বলিল, খবরদার দাদাবাবু, কখনও যেন গন্ধের লোভে ভিতরে ঢুকবেন না। বরং ও সাঁওতাল বেটাদের বলবেন, ওরা ঠিক জানে সব, কোথা কি আছে। ফুলের ওপর ওদের খুব ঝোঁক তো!
অকস্মাৎ বৃদ্ধ রংলাল মহা উৎসাহিত হইয়া উঠিল, বলিল, যাবেন দাদাবাবু সাঁওতালপাড়ায়? আ-হা-হা, কি ফসলই সব লাগিয়েছে, অঃ, আলু হয়েছে কি, ইয়া মোটা মোটা! বরবটি শুঁটি আপনার আধা হাত করে লম্বা! সাধে কি আর গাঁসুদ্ধ নোক হঠাৎ ক্ষেপে উঠল দাদাবাবু!
অহি আশ্চর্য হইয়া বলিল, সাঁওতাল কোথায়? ওরা তো থাকে অনেক দূরে পাহাড়ের ওপর।
ঘাড় নাড়িয়া রংলাল বলিল, অ্যাই দেখেন, আপনি কিছুই জানেন না। চরে যে সাঁওতাল বসেছে গো? উই দেখেন, ধোঁয়া উঠছে না! বেটারা সব রান্না চড়িয়েছে। ওরাই তো চোখ ফুটিয়ে দিলে গো। আমাদের বাঙালী জাতের সাধ্যি কি, এই বন কেটে আর ওই সব জন্তুজানোয়ার মেরে এখানে চাষ করে! ওরা কিন্তু ঠিক বেছে বেছে আসল জায়গাটি এসে ধরেছে। কোথা থেকে এল আর কবে এল-কেউ জানে না, ওরা আপনিই এসেছে, আপন মগজেই খানিকটা জায়গা-জমি সাফ করে বসেছে, চাষ করছে, এইবার সব ঘর তুলেছে। গাঁয়ের লোক তো জানলে, ওখানে মাঝি বসেছে, চাষ হচ্ছে। সেই দেখেই তো চোখ ফুটলো সব। বাস, আর যায় কোথা, লেগে গেল ফাটাফাটি! জমিদার বলছে চর আমাদের; আমরা চাষীরা বলছি, ইপারে আমাদের জমি গিয়ে ওপারে চর উঠেছে, চর আমাদের। আসল ব্যাপারটা হল–ওই সাঁওতালরা ওখানে সোনা ফলাচ্ছে, বুঝলেন?
অহীন্দ্র অগ্রসর হইয়া বলিল, চল, যাব। কোন্ দিকে?
ওই দেখেন, বেনার ঝোপ থেকে মাঝিনদের দল বেরিয়েছে লদীতে জল আনতে।
অহীন্দ্র দেখিল, গাঢ় সবুজ বেনাবনের মধ্য হইতে বাহির হইতেছে আট-দশটি কালো মেয়ের সারি, মাথায় কলসী লইয়া একটানা সুরে গান গাহিতে গাহিতে তাহারা নদীর দিকে চলিয়াছে।
দুই পাশে এক বুক কাশ ও বেনাঘাসের জঙ্গল। তাহারই মধ্য দিয়া স্বল্পপরিসর পরিচ্ছন্ন একটি পথ সর্পিল ভঙ্গিতে চরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে। ঘাসের বনের মধ্যে নানা ধরনের অসংখ্য লতা ও গাছ জন্মিয়াছে; গুচ্ছ গুচ্ছ বেনাঘাস অবলম্বন করিয়া লতাগুলি লতাইয়া লতাইয়া ঘাসের মাথায় যেন আচ্ছাদনী প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছে! সাপের ফণার মত উদ্যত বঙ্কিম ডগাগুলি স্থানে স্থানে একেবারে পথের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে, মানুষের গায়ে ঠেকিয়া সেগুলি দোল খায়। মাঝে মাঝে চৈত্রের উতলা বাতাস আসিয়া ঘাসের জঙ্গলের এক প্রান্ত পর্যন্ত অবনত করিয়া দিয়া যেন ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র সরসর সনসন শব্দ।
রংলাল একটা লতার ডাঁটা টানিয়া ছিড়িয়া লইয়া বলিল, অঃ, অনন্তমূল হয়েছে দেখ দেখি! কত যে লতা আছে!
অহীন্দ্র এই পথটির পরিচ্ছনতা দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া সাঁওতালদের কথা ভাবিতেছিল-এমন কালো জাতি, অথচ কি মসৃণ পরিচ্ছনতা ইহাদের জীবনে! কোথায় যেন বনান্তরালে কোলাহল শুনা যাইতেছে। চারিদিকে চাহিয়া অহীন্দ্র দেখিল, একেবারে ডানদিকে কতকগুলি কুঁড়েঘরের মাথা জাগিয়া আছে। পথে একটা বাঁক পার হইয়াই সহসা যেন তাঁহারা পল্লীর মধ্যে আসিয়া পড়িল।
ঘাসের জঙ্গল অতি নিপুণভাবে পরিষ্কার করিয়া ফেলিয়া তাহারই মধ্যে দশ-বারো ঘর আদিম অর্ধ-উলঙ্গ কৃষ্ণবর্ণ মানুষ বসতি বাঁধিয়াছে। ঘর এখনও গড়িয়া উঠে নাই, সাময়িকভাবে চালা বাঁধিয়া, চারিদিকে বেড়া দিয়া তাহার উপর মাটির প্রলেপ লাগাইয়া তাহারই মধ্যে এখন তাহারা বাস করিতেছে। আশপাশের মাটির দেওয়াল দিয়া স্থায়ী ঘরের পত্তনও শুরু হইয়াছে। প্রত্যেক ঘরের সম্মুখে গোবর ও মাটি দিয়া নিকানো পরিচ্ছন্ন উঠান। উঠানের পাশে পৃথক্ পৃথক্ আঁটিতে বাঁধা নানা প্রকার শস্যের বোঝা। বরবটির লতা, আলুগুলি ছাড়াইয়া লইয়া সেই গাছগুলি, মুসুরির ঝাড়, ছোলার ঝাড় সবই পৃথক্ পৃথক্ ভাবে রক্ষিত; দেখিয়া অহীন্দ্র মুগ্ধ হইয়া গেল।
রংলাল ডাকিয়া বলিল, কই, মোড়ল মাঝি কই রে? কে এসেছে দেখ!
কে বেটে? -তু কে বেটিস? -বলিতে বলিতে বাহির হইয়া আসিল এক কৃষ্ণকায় সচল প্রস্থরখণ্ড। আকৃতির চেয়ে আকারটাই তাহার বড় এবং সেইটাই চোখে পড়িয়া মানুষকে বিস্মিত করিয়া দেয়। পেশীর পুষ্টিতে এবং দৃঢ়তা ও বিপুলতায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি যেন খর্ব হইয়া গিয়াছে; লোকটি সবিস্ময়ে উগ্র-গৌরবর্ণের কৃশকায় দীর্ঘতনু বালকটিকে দেখিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
রংলাল বলিল, তোর তো অনেক বয়স হল, তোদের রাঙাঠাকুরের নাম জানিস? তোদের সাঁওতালী হাঙ্গামার সময়-
রংলালকে আর বলিতে হইল না, বিশাল বিন্ধ্যপর্বত যেন অগস্ত্যের চরণে সাষ্টাঙ্গে ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িল।
রংলাল বলিল, ইনি তাঁর লাতি- ছেলের ছেলে, বেটার বেটা।
মাঝি আপন ভাষায় ব্যস্তভাবে আদেশ করিল, চৌপায়া নিয়ে আয়, শিগ্গির!
ছোট্ট টুলের আকারে দড়ি দিয়া বোনা বসিবার আসনে অহীন্দ্রকে বসাইয়া মাঝি তাহার সম্মুখে মাটির উপর উবু হইয়া হাত দুইটি জোড় করিয়া বসিয়া অহীন্দ্রকে দেখিতে দেখিতে বলিল, হুঁ ঠিক সেই পারা, তেমুনি মুখ, তেমুনি আগুনের পারা রঙ, তেমুনি চোখ! হুঁ, ঠিক বেটে, ঠিক বলেছিস তু মোড়ল।
রংলাল হাসিয়া বলিল, তুই তাকে দেখেছিস মাঝি?
হুঁ, দেখলাম বৈকি গো। শাল-জঙ্গলে মাদল বাজছিলো, হাঁড়িয়া খাইছিলো সব বড় বড় মাঝিরা, আমরা তখন সব ছোট বেটে; দেখলাম সি, সেই আগুনের আলোতে রাঙাঠাকুর এল।
অহীন্দ্র আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, তোমার কত বয়স হবে মাঝি?
অনেক চিন্তা করিয়া মাঝি বলিল, সি অনেক হল বৈকি গো, তা তুর দুকুড়ি হবে।
রংলাল হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, ওদের হিসেব অমনই বটে। তা ওর বয়েস পঁচাত্তর-আশি হবে দাদাবাবু।
পঁচাত্তর-আশি! অহীন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল, এখনও এই বজ্রের মত শক্তিশালী দেহ! ইতিমধ্যে পাড়ার যত সাঁওতাল এবং ছেলেমেয়েরা অহীন্দ্রের চারিপাশে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাহাকে দেখিতেছিলে। পাড়াময় রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছে, রাঙাঠাকুরের বেটার বেটা আসিয়াছে, আর তিনি নাকি ঠিক রাঙাঠাকুরের মত দেখিতে- আগুনের মত গায়ের রঙ! ভিড়ের সম্মুখেই ছিল মেয়েদের দল। কষ্টিপাথরে খোদাই-করা মূর্তির মত দেহ, তেমনই নিটোল এবং দৃঢ় তৈলমসৃণ কষ্টির মত উজ্জ্বল কালো। পরনে মোটা খাটো কাপড়, মাথার চুলে তেল দিয়া পরিপাটি করিয়া আঁচড়াইয়া এলোখোঁপা বাঁধিয়াছে, সিঁথি উহারা কাটে না, কানে খোঁপায় নানা ধরনের পাতা-সমেত সদ্যফোটা বনফুলের স্তবক। অহীন্দ্র অনুভব করিল, সেই গন্ধ এখানে যেন বেশ নিবিড় হইয়া উঠিতেছে।
সে প্রশ্ন করিল, এ কোন ফুলের গন্ধ মাঝি?
মাঝি মেয়েদের মুখের দিকে চাহিল। চার-পাঁচজনে কলরব করিয়া কি বলিয়া উঠিয়া আপন আপন খোঁপা হইতে ফুলের স্তবক খুলিয়া ফেলিল। অহীন্দ্র দেখিল, লবঙ্গের মত ক্ষুদ্র আকারের ফুল, একটি স্তবকে কদম্বকেশরের মত গোল হইয়া অসংখ্য ফুটিয়া আছে। কিন্তু মোড়ল মাঝি গম্ভীর ভাবে কি বলিল। মেয়েগুলি ফুলের স্তবক আবার খোঁপায় গুঁজিয়া সারি বাঁধিয়া ওই দমকা বাতাসের মত ওই বেনাবন ঠেলিয়া কোথায় চলিয়া গেল।
রংলাল বলিল, কি হ’ল? কোথায় গেল সব?
ফুল আনতে, রাঙাবাবুর লেগে।
কেনে, ওই ফুল দিলেই তো হ’ত।
ধ্যুৎ, রাঙাঠাকুরের লাতিকে ওই ফুল দিতে আছে? তুরা দিস?
অহীন্দ্র বলিল, না গেলেই হ’ত মাঝি, কত সাপ আছে চরে? নাই?
তাচ্ছিল্যের সহিত মাঝি বলিল, উ সব সরে যাবে, কুন্ দিকে পালাবে তার ঠিক নাই।
অহীন্দ্র বলিল, এখানে নাকি খুব বড় বড় সাপ আছে?
অহীন্দ্রের কথাকে ঢাকিয়া দিয়া মেয়ের ও ছেলের দল কলরব করিয়া উঠিল। মাঝি হাসিয়া বলিল, আজই একটা মেরেছি আমরা, দেখবি বাবু? ইয়া চিতি।
সোৎসাহে আসন হতে উঠিয়া পড়িয়া অহীন্দ্র বলিল, কোথায়? কই? সঙ্গে সঙ্গে পরমোৎসাহে মাঝির দল আগাইয়া চলিল, সর্বাগ্রে ছেলেমেয়েরা যেন নাচিয়া চলিয়াছে। পল্লীর এক প্রান্তে এক বিশাল অজগর ক্ষতবিক্ষত দেহে মরিয়া তাল পাকাইয়া পড়িয়া আছে চিত্রিত মাংসস্তূপের মত। অহীন্দ্র ও রংলাল উভয়েই শিহরিয়া উঠিল। অহীন্দ্র প্রশ্ন করিল, কোথায় ছিল?
মাঝি পরম উৎসাহভরে বিকৃত ভাষায় বকিয়া গেল অনেক, সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা নাড়িবার কি তাহার বিচিত্র ভঙ্গী! মোটমাট ঘটনাটা ঘটিয়াছিল এই-একটা নিতান্ত কচি ছাগল ছানা, আপনার মনেই নাকি লাফাইয়া বেনাবনের কোল ঘেঁষিয়া নাচিয়া ফিরিতেছিল। নিকটেই একজন মাঝি বসিয়া বাঁশী বাজাইতেছিল, আর কাছে ছিল তাহার কুকুর। কুকুরটা সহসা সভয়ে গর্জন করিয়া উঠিতেই মাঝি তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিল, সর্বনাশ, সাপ বেনাবন হইতে হাতখানেক মুখ বাহির করিয়া নিমেষহীন লোলুপ দৃষ্টিতে দেখিতেছে ওই নর্তনরত ছাগশিশুটিকে। সাঁওতালের ছেলে বাঁশীটি রাখিয়া দিয়া তুলিয়া লইল ধনুক আর কাঁড় তীর। তারপর অব্যর্থ লক্ষ্যে সাপের মাথাটাই বিঁধিয়া দিল একেবারে মাটির সঙ্গে; তারপর চীৎকার করিয়া ডাকিল পাড়ার লোককে। তখন বিদ্ধমস্তক অজগর দীর্ঘ নমনীয় দেহ আছড়াইয়া ঘাসের বনে যেন তুফান তুলিয়া দিয়াছে। কিন্তু পাঁচ-সাতটা ধনুক হইতে সুতীক্ষ্ণ শরবর্ষণের মুখে সে বীর্য কতক্ষণ!
সাপ দেখিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিতেই একটি প্রৌঢ় সাঁওতাল-রমনী একটি বাটিতে সদ্যদোহা দুধ আনিয়া নামাইয়া দিল, দুধের উপর ফেনা তখনও ভাঙে নাই। মেয়েটি সম্ভ্রম করিয়া বলিল, বাবু তুমি খান।
অহীন্দ্র হাসিয়া ফেলিল। মাঝি বলিল, ই আমার মাঝিন বেটে বাবু! লে, গড় কর্ রাঙাবাবুকে-আমাদের রাঙাঠাকুরের লাতি।
রংলাল গালে হাত দিয়া কি ভাবিতেছিল, অকস্মাৎ আক্ষেপ করিয়া বলিয়া উঠিল, অ্যাঁ, একেই বলে ইঁদুরে গর্ত করে, সাপে ভোগ করে।
দুধের বাটিটা নামাইয়া দিয়া অহীন্দ্র বলিল, কেন?
ম্লান হাসি হাসিয়া রংলাল বলিল, কেন আবার, চর উঠল লদীতে, সাপখোপের ভয়ে কেউ ই-দিক আসত না। মাঝিরা এল, সাফ করছে, চাষ করছে; উ-দিকে জমিদার সাজছে লাঠি নিয়ে। -কি? না, চর আমাদের। আমরা যত সব চাষী-প্রজা বলছি, চর আমাদে র। এর পর মাঝিদের তাড়িয়ে দিয়ে সবাই বসবে জেঁকে।
মাঝি তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, কেনে, আমরাও খাজনা দিব। তাড়াবে কেনে আমাদিগে?
রংলাল বলিল, তাই শুধো গা গিয়ে বাবুদিগে। আর খাজনা দিবি কাকে? সবাই বলবে, আমাকে দে ষোল-আনা খাজনা।
কেনে, আমরা খাজনা দিব আমাদের রাঙাঠাকুরের লাতিকে- এই রাঙাবাবুকে।
অহীন্দ্র বলিল, না না মাঝি, চর যদি আমাদের না হয় তো আমাকে খাজনা দিলে হবে কেন? যার চর হবে, তাকেই খাজনা দেবে তোমরা।
তবে আমরা তুকেই খাজনা দিব, যাকে দিতে হয় তু দিস।
রংলাল হুঁশিয়ার লোক, প্রবীণ চাষী, ভূমিসংক্রান্ত আইন-কানুন সে অনেকটাই বোঝে, আর এও সে বোঝে যে, চরের উপর চক্রবর্তী-বাড়ির স্বত্ব যদি কোনরূপে সাব্যস্ত হয়, তবে অন্য বাড়ির মত অন্যায়-অবিচার হইবে না, তাহাদেরও অনেক আশা থাকিবে। অন্তত মায়ের কথার কখনও খেলাপ হয় না। সে অহীন্দ্রের গা টিপিয়া বলিল, বাবু ছেলেমানুষ, উনি জানেন না মাঝি। চর ওঁদেরই বটে।
মাঝি বলিল, আমরা সোবাই বলব, আমাদের রাঙাবাবুর চর।
কথাটা কিন্তু চাপা পড়িয়া গেল, সেই মেয়ে কয়টি যেমন ছুটিতে ছুটিতে গিয়াছিল, তেমনি ছুটিতে ছুটিতে ফিরিয়া আসিয়া রাঙাবাবুর সম্মুখে থমকিয়া দাঁড়াইল, তাহাদের সকলেরই কোঁচড়ভরা ওই ফুলের স্তবক। একে একে তাহারা আঁচল উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিল ফুলের রাশি। অতি সুমধুর গন্ধে স্থানটার বায়ুস্তর পর্যন্ত আমোদিত হইয়া উঠিল।
মাঝি একটি দীর্ঘাঙ্গী কিশোরীকে দেখাইয়া বলিল, এই দেখ্ রাঙাবাবু, ই আমার লাতিন বেটে! ওই যি আজ সাপ মেরেছে, উয়ার সাথে ইয়ার বিয়া হবে।
লজ্জাকুণ্ঠাহীন অসঙ্কোচ দৃষ্টিতে মেয়েটি তাহারই দিকে চাহিয়া ছিল, চাহিয়াই রহিল। অহীন্দ্র বলিল, আজ যাই মাঝি।
মেয়েরা সকলে মিলিয়া কলরব করিয়া কি বলিয়া উঠিল। মাঝি হাসিয়া বলিল, মেয়েগুলা বুলছে, উয়ারা নাচবে সব, তুকে দেখতে হবে।
কিন্তু সন্ধ্যে হয়ে গেল যে মাঝি।
মাঝি বলিল, মশাল জ্বেলে আমি তুকে কাঁধে করে রেখে আসব।
অহীন্দ্র আর ‘না’ বলিতে পারিল না। এমন সুন্দর ইহাদের নাচ, আর এত সুন্দর ইহাদের একটানা সুরের সুকণ্ঠের গান যে তাহা দেখিবার ও শুনিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। সে বলিল, তবে একটু শিগ্গির মাঝি।
মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে কলরব করিতে করিতে ছুটিয়া চলিয়া গেল, সিরিং সিরিং অর্থাৎ গান গান। মরং বাবু রাঙাবাবু, অর্থাৎ তাদের মালিক রাজা রাঙাবাবু দেখিবেন।
মাদল বাজিতে লাগিল-ধিতাং ধিতাং, বাঁশের বাঁশীতে গানের সুর ধ্বনিত হইয়া উঠিল। অর্ধচন্দ্রাকারে রাঙাবাবুকে বেষ্টন করিয়া বসন্ত বাতাসে দোলার মত হিল্লোলিত দেহে দুলিয়া দুলিয়া নাচিতে আরম্ভ করিল সাঁওতাল তরুণীরা, সঙ্গে সঙ্গে বাঁশীর সুরের সঙ্গে সুর মিলাইয়া গান। বৃদ্ধ মাঝি বসিয়া ছিল অহীন্দ্রের পাশে, অহীন্দ্র তাহাকে প্রশ্ন করিল, গানে কি বলছে মাঝি?
বলছে উয়ারা, রাজার আমাদের বিয়া হবে; তাতেই রাণী সাজ ক’রে বসে আছে, রাজা তাকে লাল জবাফুল এনে দিবে।
পরক্ষণেই অশীতিপর বৃদ্ধ প্রায় লাফ দিয়া উঠিয়া একটি মাদল লইয়া বাদক পুরুষদের সঙ্গে নাচিয়া নাচিয়া বাজাইতে আরম্ভ করিল।
* * *
রাত্রি প্রায় আটটার সময়, রায়বাবুদের কাছারীর সম্মুখ দিয়া কাহারা যাইতেছিল মশালের আলো জ্বালাইয়া। মশাল একালে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। ইন্দ্র রায় গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, কে যায়?
শুষ্ক বেনাঘাসের আঁটি বাঁধিয়া তাহাতে মহুয়ার তেল দিয়া মশাল জ্বালাইয়া বৃদ্ধ মাঝি তাহাদের রাঙাবাবুকে পৌঁছাইয়া দিতে চলিয়াছিল। সে উত্তর দিল, আমি বেটে, উ পারের চরের কমলা মাঝি।
বিস্মিত হইয়া রায় প্রশ্ন করিলেন, এত রাত্রে এমন আলো জ্বেলে কোথায় যাবি তোরা?
আমাদের রাঙাঠাকুরের লাতি মশায়, আমাদের রাঙাবাবুকে বাড়িতে দিতে যেছি গো!
রাঙাঠাকুর! সোমেশ্বর চক্রবর্তী! রায়ের মনে পড়ে গেল অতীতের কাহিনী।